খুলনা শিপইয়ার্ড – ইতিহাস, কার্যক্রম, গুরুত্ব ও ভ্রমণ গাইড
খুলনা শিপইয়ার্ড পরিচিতি-
খুলনা শিপইয়ার্ড বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি অন্যতম রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্যিক জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। এটি খুলনা শহরের রূপসা নদীর তীরে অবস্থিত এবং বর্তমানে বাংলাদেশ নৌবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে। এ শিপইয়ার্ড দেশের সামুদ্রিক নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শিপইয়ার্ডটি স্বাধীনতার পর সরকারি মালিকানায় পরিচালিত হলেও ১৯৯৯ সালে এর দায়িত্ব গ্রহণ করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। এরপর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি প্রযুক্তিগত ও আর্থিক দিক থেকে ব্যাপক উন্নতি লাভ করে।
ইতিহাস-
খুলনা শিপইয়ার্ডের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৭ সালে, পাকিস্তান আমলে, Khulna Dockyard and Engineering Works Ltd নামে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এটি বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে আসে। তবে ১৯৯০-এর দশকের শেষভাগে আর্থিক সংকটে পড়লে, ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অধীনে এর দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়।
নৌবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় আসার পর থেকেই খুলনা শিপইয়ার্ড দেশের জাহাজ নির্মাণ খাতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে।
অবস্থান ও অবকাঠামো-
অবস্থান:
খুলনা সিটি করপোরেশনের অন্তর্গত রূপসা নদীর তীরে, শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে।
ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক:
অক্ষাংশ: ২২.৮০৮৪° উত্তর | দ্রাঘিমাংশ: ৮৯.৫৬৭৬° পূর্ব
মূল অবকাঠামো:
- ড্রাই ডক এবং স্লিপওয়ে
- ভারী ক্রেন ও গ্যান্ট্রি
- ওয়েল্ডিং ও ফ্যাব্রিকেশন ওয়ার্কশপ
- পেইন্টিং ও আউটফিটিং ইউনিট
- মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
- নৌ স্থাপত্য (Naval Architecture) বিভাগ
- উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধান
মালিকানা ও পরিচালনা-
খুলনা শিপইয়ার্ড সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাধীন এবং পরিচালনা করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। এটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত একটি লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে কাজ করে।
নৌবাহিনীর কড়া শৃঙ্খলা ও পরিচালনায় এটি একটি সফল রাষ্ট্রীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে।
উৎপাদন ক্ষমতা ও সুবিধাসমূহ-
খুলনা শিপইয়ার্ডে বিভিন্ন ধরনের জাহাজ নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং মেরামতের সুবিধা রয়েছে। এর অন্তর্ভুক্ত:
- জাহাজ নির্মাণ প্ল্যান্ট
- ড্রাই ডক ও স্লিপওয়ে
- ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশ উৎপাদন ইউনিট
- বিদ্যুৎ ও কন্ট্রোল সিস্টেম বিভাগ
- নকশা ও গবেষণা বিভাগ (R&D)
এখানে প্রায় ১৫০০ জন দক্ষ কর্মী, প্রকৌশলী ও নৌ-প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল নিয়োজিত রয়েছে।
নির্মিত জাহাজের ধরন-
খুলনা শিপইয়ার্ডে নির্মিত হয় বিভিন্ন ধরনের নৌযান। যেমন:
- ফাস্ট পেট্রোল বোট (FPB)
- ইনশোর পেট্রোল ভেসেল (IPV)
- ল্যান্ডিং ক্রাফট ইউটিলিটি (LCU)
- টাগবোট ও অয়েল বার্জ
- মাছ ধরার ট্রলার ও সার্ভে ভেসেল
- যাত্রী ফেরি ও মালবাহী জাহাজ
বাংলাদেশ ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারেও এ শিপইয়ার্ড থেকে জাহাজ রপ্তানি করা হয়েছে।
প্রতিরক্ষায় অবদান-
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য আধুনিক নৌযান তৈরি করে খুলনা শিপইয়ার্ড দেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। নিজস্বভাবে তৈরি পেট্রোল বোট, গানবোট এবং ল্যান্ডিং ভেসেল দেশের সামুদ্রিক নিরাপত্তা জোরদারে সাহায্য করছে।
এছাড়া নৌবাহিনীর বিদ্যমান জাহাজসমূহের রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিকায়নেও শিপইয়ার্ড গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
অর্থনৈতিক ও শিল্প গুরুত্ব-
খুলনা শিপইয়ার্ড খুলনার অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে:
- চাকরির সুযোগ: সহস্রাধিক লোক এখানে কর্মরত
- কারিগরি দক্ষতা: ট্রেনিং ও দক্ষতাভিত্তিক কাজের সুযোগ
- স্থানীয় শিল্পে সহযোগিতা: স্থানীয় সরবরাহকারীদের সহায়তা
- রপ্তানি সম্ভাবনা: আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে
এটি খুলনা অঞ্চলে একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করে।
প্রশিক্ষণ ও গবেষণা-
খুলনা শিপইয়ার্ডে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ওয়েল্ডিং, ডিজাইনিং প্রভৃতি বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এখানে একটি নৌ প্রশিক্ষণ স্কুল (Naval Training School) রয়েছে, যা নৌবাহিনী এবং বেসামরিক প্রকৌশলীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম-
পরিবেশ রক্ষায় খুলনা শিপইয়ার্ড সচেতন:
- বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা
- ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ETP)
- ইকো-ফ্রেন্ডলি পেইন্ট ও হাল প্রক্রিয়া
- শব্দ ও কম্পন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা
খুলনা শিপইয়ার্ড পরিদর্শন-
সাধারণত এটি একটি প্রতিরক্ষাধীন এলাকা হওয়ায় জনসাধারণের প্রবেশাধিকার সীমিত। তবে কারিগরি প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি প্রতিনিধি দল পূর্বানুমতির মাধ্যমে শিপইয়ার্ড পরিদর্শনের সুযোগ পেতে পারে।
ঘুরে দেখার সেরা সময়-
খুলনা শিপইয়ার্ড পরিদর্শনের সেরা সময় হলো শীতকাল (নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি)। এ সময় আবহাওয়া অনুকূলে থাকে এবং নদীর পানি স্বাভাবিক থাকে, যা শিপইয়ার্ড কার্যক্রম দেখার জন্য উপযুক্ত।
উপসংহার-
খুলনা শিপইয়ার্ড বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীল প্রতিরক্ষা ও শিল্প উন্নয়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এটি একটি আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ নির্মাণ কারখানায় পরিণত হয়েছে।
শুধু প্রতিরক্ষায় নয়, অর্থনীতি, প্রযুক্তি, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানে এর অবদান অনস্বীকার্য। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সামুদ্রিক সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিতে খুলনা শিপইয়ার্ড একটি অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী-
প্রশ্ন: খুলনা শিপইয়ার্ড কী?
উত্তর: খুলনা শিপইয়ার্ড বাংলাদেশের একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্যিক জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান।
প্রশ্ন: খুলনা শিপইয়ার্ড কখন প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর: এটি ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আসে।
প্রশ্ন: এখানে কী ধরনের জাহাজ তৈরি হয়?
উত্তর: পেট্রোল বোট, ল্যান্ডিং ক্রাফট, ফেরি, টাগবোট, মাছ ধরার ট্রলার ইত্যাদি।
প্রশ্ন: কি সাধারণ মানুষ খুলনা শিপইয়ার্ডে যেতে পারে?
উত্তর: সাধারণভাবে না, তবে বিশেষ অনুমতির মাধ্যমে শিক্ষার্থী বা সরকারি দল পরিদর্শন করতে পারে।
প্রশ্ন: খুলনা শিপইয়ার্ড কি প্রতিরক্ষায় ভূমিকা রাখে?
উত্তর: হ্যাঁ, এটি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য জাহাজ তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রশ্ন: শিপইয়ার্ডে কতজন কর্মরত?
উত্তর: প্রায় ১৫০০ জন প্রকৌশলী, কারিগরি কর্মী ও নৌ-প্রশিক্ষিত জনবল এখানে কাজ করেন।
প্রশ্ন: শিপইয়ার্ড পরিবেশ বান্ধব কিনা?
উত্তর: হ্যাঁ, পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি এখানে কার্যকরভাবে অনুসরণ করা হয়।