খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর: দক্ষিণ বাংলার ঐতিহ্যের জানালা

খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর

খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর দক্ষিণ বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব ও সংস্কৃতির অন্যতম সংরক্ষিত নিদর্শন। খুলনা শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত এই জাদুঘরটি শুধু স্থানীয় সংস্কৃতির ধারক নয়, বরং গবেষণা, শিক্ষা এবং পর্যটনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে।

এই জাদুঘরটি বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হয় এবং মূলত খুলনা বিভাগের বিভিন্ন প্রত্নস্থল যেমন—খলিফাতাবাদ ও ভরতভাইনার নিদর্শন এখানে সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত হয়।

ইতিহাস ও প্রতিষ্ঠা-

খুলনা বিভাগের প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্থানীয় মানুষের কাছে নিজস্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতি পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে এই জাদুঘরটি গঠিত হয়, যা আজ দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান।

প্রধান সংগ্রহ ও প্রদর্শনী-

জাদুঘরের গ্যালারিগুলোতে বহু প্রাচীন ও মূল্যবান নিদর্শন সংগ্রহ ও প্রদর্শন করা হয়েছে:

১. প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন

  • প্রাচীন টেরাকোটা ফলক
  • হিন্দু ও বৌদ্ধ দেব-দেবীর মূর্তি
  • মধ্যযুগীয় যুগের বাসনপত্র ও যন্ত্রপাতি

২. ইসলামি ঐতিহ্য

  • খলিফাতাবাদের মসজিদ ও সমাধির পাথরের শিলালিপি
  • সুলতানি আমলের ইসলামি শিল্পকর্ম ও অলংকার

৩. মুদ্রা সংগ্রহ

  • গুপ্ত, পাল ও সুলতানি আমলের প্রাচীন মুদ্রা
  • সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষায় উৎকীর্ণ রৌপ্য ও তামার মুদ্রা

৪. জাতিগত ও লোকজ উপকরণ

  • স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী ব্যবহার্য বস্তু
  • কৃষিকাজ ও সংগীতের যন্ত্র, তাঁতের কাপড়

৫. অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম

  • মুঘল ও ঔপনিবেশিক আমলের তলোয়ার, বর্শা, বন্দুক

স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য-

খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর একটি আধুনিক নকশার ভবন। এর প্রশস্ত গ্যালারি, প্রাকৃতিক আলো, এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নিদর্শন সংরক্ষণের ব্যবস্থা দর্শনার্থীদের জন্য আরামদায়ক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করে।

বাহিরে সবুজ বাগান ও খোলা চত্বরে কিছু ভাস্কর্যও আছে, যা সম্পূর্ণ ভ্রমণকে আরও মনোমুগ্ধকর করে তোলে।

শিক্ষামূলক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা-

এই জাদুঘর শুধু প্রদর্শনের জায়গা নয়, এটি একটি সক্রিয় গবেষণা ও শিক্ষার কেন্দ্র। এখানে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়:

  • প্রত্নতত্ত্ব ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ বিষয়ক সেমিনার
  • অস্থায়ী প্রদর্শনী
  • বিদ্যালয়ভিত্তিক শিক্ষা সফর
  • জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষকদের সঙ্গে যৌথ প্রকল্প

পরিদর্শনের তথ্য-

অবস্থান:

খুলনা শহরের উত্তরে, সহজেই রিকশা, বাস বা প্রাইভেট গাড়িতে পৌঁছানো যায়।

সময়সূচি:

  • শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার: সকাল ১০টা – বিকেল ৫টা
  • শুক্রবার: বিকেল ৩টা – সন্ধ্যা ৭টা
  • সোমবার ও সরকারি ছুটিতে বন্ধ

প্রবেশ মূল্য:

  • সাধারণ দর্শনার্থী: ২০ টাকা
  • শিক্ষার্থী: ৫ টাকা
  • বিদেশি দর্শনার্থী: ১০০ টাকা

সুবিধাসমূহ:

  • পার্কিং
  • তথ্যকেন্দ্র
  • স্যুভেনির দোকান
  • শৌচাগার
  • গাইডেড ট্যুর (অনুরোধ সাপেক্ষে)

খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর ভ্রমণের সেরা সময়-

নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি হলো খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। কারণ এই সময়ে:

  • আবহাওয়া শীতল ও আরামদায়ক থাকে
  • ভ্রমণ ও দর্শনীয় স্থান ঘোরার জন্য সুবিধাজনক
  • বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ কিংবা সুন্দরবনের মতো কাছাকাছি স্থানও ঘোরা যায়

বর্ষাকালে (জুন–সেপ্টেম্বর) অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে ভ্রমণে সমস্যা হতে পারে, তাই এই সময়টি এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম।

উপসংহার-

খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর খুলনা বিভাগের ইতিহাস, শিল্প ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ ধারক। এখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ইসলামি শিল্প, লোকজ উপকরণ এবং মুদ্রা সংগ্রহ শুধু অতীতকে জানার সুযোগ দেয় না, বরং আমাদের ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধও জাগায়।

আপনি যদি ইতিহাসপ্রেমী হন কিংবা শিশুদের নিয়ে শিক্ষামূলক ভ্রমণ করতে চান, এই জাদুঘর হতে পারে একটি চমৎকার গন্তব্য। একদিন সময় বের করে এসে ঘুরে দেখুন খুলনার এই ইতিহাসের ঘর।

সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী –

খুলনা বিভাগীয় জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় সংগ্রহ কী কী?
খলিফাতাবাদ ও ভরতভাইনার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, প্রাচীন টেরাকোটা, মুদ্রা, এবং ইসলামি শিলালিপি।

ভিতরে ছবি তোলা যায় কি?
হ্যাঁ, সাধারণত ফ্ল্যাশ ছাড়া ছবি তোলার অনুমতি দেওয়া হয়। কিছু বিশেষ প্রদর্শনীতে সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে।

গাইডেড ট্যুর পাওয়া যায় কি?
হ্যাঁ, অনুরোধ করলে গাইডেড ট্যুর পাওয়া যায়, বিশেষ করে স্কুল বা গবেষণা সফরের জন্য।

শিশুদের জন্য উপযুক্ত কি না?
অবশ্যই। শিশুদের জন্য শিক্ষা উপযোগী নানা নিদর্শন ও তথ্য রয়েছে।

বিদেশিরা জাদুঘর পরিদর্শন করতে পারবে কি?
হ্যাঁ, বিদেশিদের জন্য প্রবেশমূল্য ১০০ টাকা এবং অধিকাংশ প্রদর্শনীর বিবরণ বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায় দেওয়া আছে।

একটি সম্পূর্ণ ভ্রমণে কত সময় লাগে?
প্রায় ১–২ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে, আপনি কতটা গভীরভাবে প্রদর্শনীগুলো দেখছেন তার ওপর নির্ভর করে।

জাদুঘরে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে কি?
হ্যাঁ, এখানে দর্শনার্থীদের জন্য আলাদা পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।

কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা অস্থায়ী প্রদর্শনী হয় কি?
হ্যাঁ, নিয়মিতভাবে অস্থায়ী প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top