উত্তাল ভারতের লাদাখ: ভূমিকা-
বর্তমানে ভারতের লাদাখ — একবার শান্ত পার্বত্য অঞ্চলে — হঠাৎ জেন-জি বিক্ষোভে উত্তাল লাদাখ হিসেবে সংবাদ শিরোনামে এসেছে। কেন এই শান্ত অঞ্চলে হঠাৎ তরুণদের তীর্থস্থান রূপ নেয় বিক্ষোভ? কী কারণে সেই বিক্ষোভ উত্তাল রূপ ধারণ করেছে? এই নিবন্ধে আমরা সেই কারণ, ঘটনাপ্রবাহ, প্রতিক্রিয়া এবং সম্ভাব্য উত্তরগুলি বিশ্লেষণ করব।
পটভূমি ও কারণ: লাদাখ কেন “শীতল” থেকে “উত্তাল” রূপ নিল?-
২০১৯ সালে ভারত সরকারের ঐকান্তিক সিদ্ধান্তে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে দুই কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এর ফলে লাদাখকে রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি না রেখে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে রাখা হয়। ফলে লাদাখের লোকেরা প্রথাগত স্বায়ত্তশাসন ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।
অনেকে মনে করেন, সেই সিদ্ধান্তের ফলে লাদাখের জনসংখ্যার রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব, ভূমি অধিকার ও স্থানীয় নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রশাসনের হাতে চলে গেছে।
লাদাখ একটি উচ্চতর শীতল মরুভূমি অঞ্চল। প্রায় ছয় বছর ধরে লাদাখের হাজার হাজার মানুষ স্থানীয় নাগরিক সংস্থাগুলোর নেতৃত্বে বৃহত্তর সাংবিধানিক সুরক্ষা ও ভারতের কাছ থেকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দাবি করে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল ও অনশন করছেন। লাদাখবাসী চান একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের ক্ষমতা। ২০১৯ সাল থেকে অঞ্চলটিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার শাসন করছে।
ছয় বছর আগে রাজ্যের মর্যাদা চলে যাওয়ায় লাদাখিরা এখন আমলাদের শাসনের অধীনে রয়েছেন। লাদাখের ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষ তপশিলি উপজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত। এই কারণে তারা ভারতের সংবিধানে ষষ্ঠ তপশিলে লাদাখকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছে। ষষ্ঠ তপশিল এমন অঞ্চলগুলোতে স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসন ও শাসন কাঠামো সরবরাহ করে, যেখানে স্বীকৃত আদিবাসী সম্প্রদায়ের আধিপত্য রয়েছে।
লাদাখে শিক্ষার হার বেশ ভালো, কিন্তু কাজের সুযোগ সীমিত। এক রিপোর্ট অনুসারে, লাদাখের স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি। তরুণদের বঞ্চনা, অতিরিক্ত প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, আত্মপরিচয় ও শাসন কাঠামোর অভাব — এসবই তরুণদের মধ্যে হতাশার বীজ বপন করেছে। অনেক তরুণ মনে করছেন, রাজ্য-স্তরের স্বায়ত্তশাসন ছাড়া ভবিষ্যতে উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায্যতা অর্জন সম্ভব হবে না। আর এইভাবে শান্ত লাদাখ অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে অশান্ত হয়ে যায়।
উত্তাল রূপ – বিক্ষোভের ধরণ ও সংঘর্ষ-
ভারতের হিমালয় অঞ্চলের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ লাদাখ উপত্যকা। সম্প্রতি ভারত-চীন উত্তেজনার কেন্দ্রে ছিল এই উপত্যকা। ২৪ সেপ্টেম্বর বুধবার জেন-জি নেতৃত্বাধীন সহিংস বিক্ষোভের মাধ্যমে উত্তাল হয়ে উঠেছে অঞ্চলটি। বিক্ষুব্ধ তরুণরা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আঞ্চলিক কার্যালয়ে আগুন দিয়েছে।
কাশ্মীরের লাদাখে পৃথক রাজ্য ও চাকরিতে কোটার দাবিতে বুধবার পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে অন্তত চারজন নিহত এবং ৫০ জনের বেশি আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিক্ষোভের সমন্বয়কারীরা। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সংঘর্ষে বহু সংখ্যক নিরাপত্তাকর্মীও আহত হয়েছেন।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে লাদাখে আর কোনো সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। তবে কোথাও চারজনের বেশি মানুষ জড়ো হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। লাদাখের রাজধানী লেহেতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর সেখানে কারফিউ জারি করেছে সরকার। লাদাখে রাতভর অভিযান চালিয়ে ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
সহিংসতায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের। বিক্ষোভে পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে এবং লাদাখের সঙ্গে সংহতি জানাতে গতকাল ওই অঞ্চলের কারগিল শহরে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। কারগিল জেলায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
কারগিল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের (কেডিএ) ডাকে কমপ্লিট শাটডাউন চলছে। সংগঠনটি কারগিলে রাজ্যের মর্যাদা ও ষষ্ঠ তপশিলে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে আন্দোলন চালাচ্ছে। লাদাখের লেহতে একই দাবিতে আন্দোলন করছে লেহ অ্যাপেক্স বডি (এলএবি)।
কেডিএ নেতা সাজাদ কারগিলি বলেন, লাদাখের লেহতে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং সেখানকার মানুষের সঙ্গে সংহতি জানাতেই এ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছে।
অনশন ধর্মঘটের সমন্বয়কারী জিগমত পালজোর বলেছেন, এটা লাদাখের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী দিন। ধর্মঘটের দাবিগুলো সমর্থন করতে রাস্তায় নামা আমাদের তরুণদের তারা হত্যা করেছে।
জেন জেড আন্দোলন (Gen Z Movement) – একটি অনুপ্রেরণা-
লাদাখের সাম্প্রতিক জেন–জি বিক্ষোভ ভারতের রাজনীতির এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করেছে। এক সময় যাকে বলা হতো “শীতল মরুভূমি”, আজ সেই লাদাখ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে তরুণদের প্রতিবাদে। তাদের দাবিগুলো কেবলমাত্র রাজনৈতিক নয়—এগুলো সামাজিক, পরিবেশগত এবং আত্মপরিচয়ের প্রশ্নের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
প্রশ্নত্তোর-
বিক্ষোভের মূল দাবি গুলো কি?
মূল দাবি: রাজ্য মর্যাদার স্বীকৃতি, ৬ষ্ঠ সূচি অন্তর্ভুক্তি, অধিক প্রতিনিধি ও ভোটাধিকার, স্থানীয় নিয়ন্ত্রণ ও রোজগার সুযোগ।
কি করে এই উত্তাল রূপান্তর হলো?
প্রথমে শান্ত আন্দোলন চললেও দাবিগুলোর প্রতি অবহেলা ও সরকারের দেরি তরুণদের মধ্যে তীব্র হতাশা বয়ে আনে, যা উত্তেজনায় রূপ নেয়।
বিক্ষোভ কি নতুন ধরনের বা সাধারণ প্রতিবাদ?
এটি নতুন ধরণের কারণ, এতে অনেক সামাজিক মাধ্যম, তরুণ নেতৃত্ব ও আন্তর্জাতিক আন্দোলন ধারার প্রতিফলন রয়েছে।
নিহত ও সংঘর্ষে কী তথ্য আছে?
পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে অন্তত চারজন নিহত এবং ৫০ জনের বেশি আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিক্ষোভের সমন্বয়কারীরা