মুসলিম রাষ্ট্রের ঐক্য: ভূমিকা-
আজকের বিশ্বে মুসলিম রাষ্ট্রের ঐক্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর একটি। ফিলিস্তিনের চলমান সংকট এবং গাজায় ইসরায়েলের নৃশংস বোমা হামলার পর আরব দেশের ইয়েমেন ও লেবানন এর পর কাতারেও হামলা করল ইসরায়েল।
পৃথিবীতে যদি কোনো দেশ ভেবেই রাখতে পারত যে ইসরায়েল তার ওপর কখনো হামলা করবে না, তাহলে তা ছিল কাতার। কাতার ছোট একটি দেশ এবং ইসরায়েলের জন্য কোনো হুমকি নয়। এর চেয়ে বড় বিষয় হলো, কাতার যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি এখানেই রয়েছে। গত মাসে গাজা যুদ্ধবিরতি আলোচনার জন্য ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান দোহায় এসে কাতারি সরকারের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। সবকিছু মিলিয়ে মনে হতে পারে, কাতার নিরাপদ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। কাতার কখনোই পুরোপুরি নিরাপদ ছিল না, এবং এটি এই অঞ্চলের ভিন্নধারার কোনো দেশও নয়। তথাপি ইসরায়েল হামাস নেতাদের দমনের দোহাই দিয়ে কাতারে হামলা চালিয়ে জান মালের ক্ষতি করে মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার আইন লঙ্ঘন করেছে।
এতে করে আরব দেশসহ বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলের বিপক্ষে নিন্দার ঝড় উঠেছে। বিশ্বজুড়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ভেতর নতুনভাবে ঐক্যের ডাক উঠেছে। বহু আরব-মুসলিম নেতা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন। এই দাবি শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং এটি মানবতা, ন্যায়বিচার ও মুসলিম উম্মাহর সম্মিলিত স্বার্থের প্রতিফলন।
(কাতারে ইসরায়েলের হামলা: নামাজে যাওয়ার কারণেই কি হামাস নেতারা বেঁচে গেছেন?)
আরব রাষ্ট্রনেতাদের দোহার সম্মেলন-
গত মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত নতুন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব নিয়ে দোহায় হামাস নেতাদের বৈঠক চলাকালে বিমান ও ড্রোন হামলা চালায় ইসরাইল। এই হামলার প্রতিবাদে সকল আরব দেশগুলোর লীগ ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) এই যৌথ বৈঠকে প্রায় ৬০টি দেশ অংশ নেয়।
হামাস জানিয়েছে, হামলায় তাদের পাঁচ সদস্য ও কাতারের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। কিন্তু ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনটির শীর্ষ কোনো নেতা নিহত হননি। এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় সোমবার জরুরি সম্মেলনটির আহ্বান করেছিল কাতার।
সম্মেলন শেষে এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরাইলের চলমান কার্যক্রম রোধে সব ধরনের আইনি ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে (বৈঠকে অংশগ্রহণকারী) সব দেশের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে।’ এসব কার্যক্রম হতে পারে- ‘ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করা এবং দেশটির বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা।’
কাতারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ উপসাগরীয় দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও বাহরাইনসহ জর্ডান, মিসর এবং মরক্কো এরই মধ্যে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এসব দেশও গতকালের সম্মেলনে অংশ নিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে ইউএই, বাহরাইন এবং মরক্কোর শীর্ষ নেতারা সম্মেলনে অংশ নেননি।
এই পাঁচটি দেশের মধ্যে মিসর ও জর্ডান আগেই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। বাকি তিনটি দেশ পাঁচ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া ‘আব্রাহাম চুক্তি’র মাধ্যমে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। গতকালের সম্মেলনে এসব দেশের নেতারা অংশ না নিয়ে ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধি পাঠিয়েছে। বিবৃতিতে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়, তারা যেন সংস্থাটির সদস্যপদ স্থগিত করতে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়।
দোহায় ইসরাইলের হামলার পর উপসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। এতে ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অঞ্চলটিতে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা রয়েছে। অঞ্চলটির বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি অবস্থিত কাতারে।
সম্মেলনে কাতারের আমির বলেন, ‘যাঁর সঙ্গে আলোচনা চলছে, তাঁকেই যদি পদ্ধতিগতভাবে হত্যার চেষ্টা করা হয়, তাহলে এর মানে স্পষ্ট। ধরে নিতে হবে, আলোচনা ভেস্তে দেওয়ারই চেষ্টা চলছে।’
সোমবারের সম্মেলনে সৌদি আরবের ডি-ফ্যাক্টো (কার্যত) শাসক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান, ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানি, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস প্রমুখ অংশ নেন।
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেন, ‘আগামীকাল যে কোনো আরব বা ইসলামি রাজধানী শহরকেও একইভাবে নিশানা করা হতে পারে।’ গত জুন মাসে ইসরায়েলের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল ইরান। একটা পর্যায়ে ইসরায়েলের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রও যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। হামলা চালিয়েছিল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায়। এর জবাবে কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছিল ইরান। পেজেশকিয়ান আরও বলেন, ‘পথ একটাই-আমাদের এক হতে হবে।’
ইসরায়েলকে আরব দেশগুলোর মধ্যে সবার আগে স্বীকৃতি দিয়েছিল মিসর। সোমবারের সম্মেলনে দেশটির প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি সতর্ক করে বলেন, কাতারে এই হামলা ‘যেকোনো নতুন শান্তিচুক্তির সুযোগকে বাধাগ্রস্ত করছে। এমনকি এরই মধ্যে হওয়া শান্তিচুক্তিগুলোও ভেস্তে দিতে পারে।’
২০২০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আব্রাহাম চুক্তি শুরু করেছিল। উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে ইউএই ও বাহরাইনের পর এখন পর্যন্ত আর কোনো দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। তবে সৌদি আরবসহ আরও কিছু দেশের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চুক্তির সদস্য দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
সম্মেলনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের অভিযোগ, ইসরায়েল ‘সন্ত্রাসী মানসিকতা’ নিয়ে এগোচ্ছে। অন্যদিকে সম্মেলনে অংশ গ্রহণকারী দেশগুলো গাজা প্রসঙ্গে ইসরায়েলের তীব্র সমালোচনা করেছে।
সম্মেলনের ফাঁকে উপসাগরীয় ধনী দেশগুলো বৈঠক করে। বৈঠক শেষে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) মহাসচিব জাসেম মোহাম্মদ আল-বুদাইউই সাংবাদিকদের বলেন, ইসরায়েলের লাগাম টেনে ধরতে যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের ‘প্রভাব ও ক্ষমতা’ কাজে লাগাতে আহ্বান জানিয়েছে দেশগুলো।
গাজা নিয়ে চাপ বাড়ছে-
জ্বালানি তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ ধনী দেশ কাতার সাধারণত শান্তিপূর্ণ হিসেবে পরিচিত। ওয়াশিংটনের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কও বেশ ভালো। তা ছাড়া গাজা যুদ্ধবিরতি প্রচেষ্টায় মিসরের পাশাপাশি দেশটিও শুরু থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছিল। তাই দেশটিতে ইসরায়েলের হামলার সবাইকে অবাক করেছে। হামলার পর ‘সমন্বিত আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়ার’ কথা জানিয়েছে কাতার।
সোমবারের জরুরি সম্মেলনের লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের ওপর চাপ বাড়ানো। তবে গাজায় হত্যাকাণ্ড ও মানবিক সংকট সৃষ্টির দায়ে দেশটির ওপর এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক চাপ বেড়েছে।
কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির অভিযোগ, দোহায় (৯ সেপ্টেম্বর) আলোচনায় বসা হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা নস্যাৎ করতে চাইছে। যুদ্ধবিরতি প্রচেষ্টায় তাঁর দেশ অন্যতম প্রধান মধ্যস্থতাকারী বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সম্মেলনে কাতারের আমির বলেন, ‘যাঁর সঙ্গে আলোচনা চলছে, তাঁকেই যদি পদ্ধতিগতভাবে হত্যার চেষ্টা করা হয়, তাহলে এর মানে স্পষ্ট। ধরে নিতে হবে, আলোচনা ভেস্তে দেওয়ারই চেষ্টা চলছে।’
ইসরায়েল আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মানে না–
আন্তর্জাতিক আইন উপেক্ষা করে এবং নিজের জন্য ‘ঈশ্বরপ্রদত্ত অধিকার’ দাবি করে অঞ্চল বিস্তার করতে চায়। যারা তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তারা তাদের শত্রু।
ইসরায়েলকে শুধু আইনভঙ্গকারী রাষ্ট্র বলা ঠিক হবে না। এটি এমন এক দেশ, যা প্রকাশ্যে সব আন্তর্জাতিক নিয়ম ও আইন প্রত্যাখ্যান করেছে। বহু বছর ধরে ইসরায়েলের নেতারা ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ বা ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’-এর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। তাঁদের সেই স্বপ্নের ইসরায়েলের সীমানা ইরাকের ইউফ্রেটিস থেকে মিসরের নীল নদ পর্যন্ত বিস্তৃত। গত আগস্টে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু টেলিভিশনে এই প্রকল্পের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার প্রকাশ করেছেন।
দুই বছর ধরে ইসরায়েল গাজাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে। ৬৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছেন। ফিলিস্তিনের বাইরে ইসরায়েল লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরানে তার যুদ্ধযন্ত্র ছড়িয়ে দিয়েছে। লেবাননে তারা স্কুল ছুটির সময় ভিড়ভাট্টাপূর্ণ এলাকায় পেজারে বিস্ফোরণ ঘটায়।
এখন কাতারে এসে ইসরায়েল আরেক ধাপ অতিক্রম করেছে। দোহায় হামলায় হামাস কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্য এবং এক কাতারি কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। কাতার এই হামলাকে ‘কাপুরুষোচিত, অপরাধমূলক আক্রমণ’ এবং ‘শতভাগ বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে নিন্দা জানিয়েছে।
মুসলিম নেতাদের আহ্বান: সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা-
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন আরব-মুসলিম নেতা প্রকাশ্যে বলেছেন—ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করা এখন সময়ের দাবি। কারণ, ইসরায়েল শুধু ফিলিস্তিনে নয়, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে। কাতার, আলজেরিয়া, তুরস্ক, ইরানসহ বেশ কিছু দেশ এরই মধ্যে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর এখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে কার্যকর ভূমিকা নেওয়া উচিত।
প্রশ্নত্তোর-
প্রশ্ন: মুসলিম রাষ্ট্রের ঐক্য কেন প্রয়োজন?
মুসলিম রাষ্ট্রের ঐক্য প্রয়োজন ফিলিস্তিন সংকট সমাধান, ইসরায়েলের আগ্রাসন প্রতিহত করা এবং মুসলিম উম্মাহর মর্যাদা রক্ষা করার জন্য।
প্রশ্ন: কোন কোন মুসলিম রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে?
কাতার, আলজেরিয়া, তুরস্ক, ইরানসহ বেশ কিছু মুসলিম রাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে।
প্রশ্ন: মুসলিম রাষ্ট্রের ঐক্য গঠনে প্রধান বাধা কী?
রাজনৈতিক বিভক্তি, অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা এবং পশ্চিমা বিশ্বের চাপ মুসলিম রাষ্ট্রের ঐক্যের প্রধান বাধা।
প্রশ্ন: মুসলিম রাষ্ট্রগুলো কিভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসরায়েলকে চাপ দিতে পারে?
তেলের অবরোধ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক চাপ এবং আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা—এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলকে চাপে ফেলতে পারে।
প্রশ্ন: মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ফিলিস্তিনের জন্য কী আনতে পারে?
মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামকে শক্তিশালী করবে, গাজার মানুষের জন্য বাস্তব সহায়তা আনবে এবং ইসরায়েলের আগ্রাসন ঠেকাতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।