সোনাডাঙ্গা সোলার পার্ক – খুলনা

সোনাডাঙ্গা সোলার পার্কসোনাডাঙ্গা সোলার পার্ক: খুলনা  একটি পরিচিতি-

সোনাডাঙ্গা সোলার পার্ক খুলনা বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। খুলনা শহরের সোনাডাঙ্গা অঞ্চলে অবস্থিত এই সোলার পার্ক দেশের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের পথপ্রদর্শক। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মুখোমুখি এই সময়ে এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব শক্তি নীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে।

অবস্থান ও সারসংক্ষেপ-

সোলার পার্কটি খুলনা বিভাগের সোনাডাঙ্গা উপজেলায় অবস্থিত। এই স্থানটি পর্যাপ্ত খালি জমি ও উপযুক্ত সূর্যরশ্মি পাওয়ার কারণে নির্বাচিত হয়। এখানে ব্যবহৃত ফটোভোল্টেইক (PV) প্রযুক্তি সূর্যালোককে সরাসরি বিদ্যুতে রূপান্তর করে।

এটি জাতীয় গ্রিডের সাথে যুক্ত, যার মাধ্যমে খুলনা ও আশেপাশের অঞ্চলে পরিষ্কার ও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হয়েছে।

পটভূমি ও নির্মাণ-

সোনাডাঙ্গা সোলার পার্ক খুলনা নির্মাণ করা হয় বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০০৮ এর আওতায়। এই নীতির লক্ষ্য ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের মোট বিদ্যুতের অন্তত ১০% নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করা।

এই প্রকল্পটি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP) মডেলে বাস্তবায়ন করা হয়। এতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (BPDB), টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (SREDA) এবং বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা অংশ নেয়।

২০১৯ সালে নির্মাণ শুরু হয় এবং ২০২১ সালের শেষ দিকে পূর্ণভাবে চালু হয়।

কারিগরি বিবরণ-

এই সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিত। এর কিছু মূল বৈশিষ্ট্য:

  • মোট ক্ষমতা: ২০ মেগাওয়াট (MW)
  • প্রযুক্তি: মনোক্রিস্টালাইন PV প্যানেল
  • ইনভার্টার: MPPT প্রযুক্তিসহ স্ট্রিং ইনভার্টার
  • ভূমি: প্রায় ১০০ একর
  • গ্রিড সংযোগ: ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশনের মাধ্যমে
  • বাৎসরিক উৎপাদন: প্রায় ৩০,০০০ মেগাওয়াট-ঘণ্টা (MWh)

এই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি বছর হাজার হাজার টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ রোধ করা সম্ভব হচ্ছে।

পরিবেশগত প্রভাব-

এই প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্যই ছিল জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ। এর কিছু পরিবেশগত উপকারিতা হলো:

  • বায়ু বা পানি দূষণ নেই
  • গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস
  • প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা
  • শব্দ দূষণহীন পরিবেশ

পাশাপাশি পার্কের আশপাশে গাছপালা ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব-

সোনাডাঙ্গা সোলার পার্ক খুলনা এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নেও বড় ভূমিকা রাখছে:

  • চাকরি সৃষ্টি: নির্মাণকালে ৩০০+ জন নিয়োগ এবং বর্তমানে ৫০+ স্থায়ী কর্মসংস্থান
  • ব্যবসা প্রসার: শিল্প ও ব্যবসা খাতে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ
  • প্রশিক্ষণ: স্থানীয় প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদদের জন্য প্রশিক্ষণ কার্যক্রম

এতে করে এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে।

চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা-

কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে এই প্রকল্পে:

  • জমি অধিগ্রহণ: নগর এলাকার জমি অধিগ্রহণ জটিলতা
  • মৌসুমি বৃষ্টি: বর্ষাকালে সৌর উৎপাদন কমে যায়
  • গ্রিড সমস্যা: কখনো কখনো বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে

তবে এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কাজ করে চলেছে।

জাতীয় শক্তি নীতির সাথে মিল-

এই প্রকল্পটি বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান ২০১৬ এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সরকারের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে ৩,০০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন। সোনাডাঙ্গা সোলার পার্ক খুলনা সেই লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা-

আগামী দিনে এই পার্ককে আরো সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে:

  • হাইব্রিড মডেল: সৌর ও ব্যাটারি সংরক্ষণ একত্রে
  • ডিজিটাল মনিটরিং: AI ও IoT প্রযুক্তি ব্যবহার
  • ক্ষমতা বৃদ্ধি: ৩০-৫০ মেগাওয়াটে উন্নীত করার প্রস্তাব

এসব পদক্ষেপ পার্কটির কার্যকারিতা ও উৎপাদন ক্ষমতা আরও বাড়াবে।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি-

বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে নবায়নযোগ্য শক্তিতে উদীয়মান দেশ হিসেবে পরিচিত। এই পার্কটি ADB, World Bank, IDCOL ইত্যাদি সংস্থার রিপোর্টেও স্থান পেয়েছে।

শিক্ষা ও পরিদর্শনের সুযোগ-

এই সোলার পার্ককে একটি পরিবেশ শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য ট্যুর, প্রজেক্ট ও ফিল্ড স্টাডি আয়োজন করা হয়। এখানে একটি সোলার একাডেমিক গ্যালারি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।

উপসংহার-

সোনাডাঙ্গা সোলার পার্ক খুলনা কেবল একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নয়—এটি বাংলাদেশের সবুজ ভবিষ্যতের প্রতীক। এটি দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে পরিবেশ রক্ষা ও জ্বালানি নিরাপত্তা একসাথে নিশ্চিত করা সম্ভব।

এই পার্ক বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই পৃথিবী গড়ার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী-

  • সোনাডাঙ্গা সোলার পার্ক খুলনার উৎপাদন ক্ষমতা কত?
    -এর উৎপাদন ক্ষমতা ২০ মেগাওয়াট, যা হাজার হাজার বাড়ির বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করতে পারে।
  • এই পার্ক কবে চালু হয়েছে?
    -২০১৯ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ২০২১ সালের শেষ দিকে পুরোপুরি চালু হয়।
  • এটি কি জাতীয় গ্রিডের সাথে যুক্ত?
    -হ্যাঁ, এই পার্কের বিদ্যুৎ ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়।
  • কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে?
    -মনোক্রিস্টালাইন ফটোভোল্টেইক (PV) প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে।
  • এই পার্ক কিভাবে পরিবেশ রক্ষা করছে?
    -প্রতি বছর হাজার হাজার টন কার্বন নিঃসরণ রোধ করে এটি পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে।
  • সাধারণ মানুষ কি পার্কটি পরিদর্শন করতে পারে?
    -হ্যাঁ, শিক্ষার্থী ও পরিবেশপ্রেমীদের জন্য পরিদর্শনের সুযোগ রয়েছে এবং ভবিষ্যতে একটি শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনাও রয়েছে।
  • এই প্রকল্পের প্রধান চ্যালেঞ্জ কী ছিল?
    -জমি অধিগ্রহণ, বর্ষাকালে উৎপাদন হ্রাস, ও গ্রিড সংযোগে জটিলতা মূল চ্যালেঞ্জ ছিল।
  • ভবিষ্যতে কি এই পার্কের ক্ষমতা বাড়ানো হবে?
    -হ্যাঁ, ৩০-৫০ মেগাওয়াটে উন্নীত করার প্রস্তাব রয়েছে এবং হাইব্রিড মডেলের পরিকল্পনাও আছে।
Leave a Reply 0

Your email address will not be published. Required fields are marked *