রাকসু নির্বাচন ২০২৫: ভূমিকা-
বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির মঞ্চে প্রাধান্য পাওয়া যায় যখন শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ বাড়ে এবং নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু হয়। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ( রাকসু )-এর নির্বাচনে ঘটে এক গভীর পরিবর্তন — “রাকসু নির্বাচন- রাকসু নির্বাচনের ২৩ পদের ২০টিতেই শিবিরের জয়” এই শিরোনামে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এই ফলাফল শুধু সংখ্যার খেলা নয়; এটি ক্যাম্পাস রাজনীতিতে নিই নতুন বার্তা দেয়—ক্যাম্পাসের নেতৃত্ব, দলীয় সংগঠন ও শিক্ষার্থীর রাজনৈতিক সচেতনতা কোথায় দাঁড়িয়েছে তা উপলব্ধি করানোর ক্ষেত্রটি।এই ব্লগে আমরা বিশ্লেষণ করব — এই নির্বাচনে কী হয়েছে, কেন হলো, এবং এর ভবিষ্যৎ প্রভাব কি হতে পারে। (চাকসু নির্বাচন- ডাকসুর পর চাকসুতেও ছাত্রশিবিরের জয়যাত্রা।)
রাকসু কি?-
রাকসু হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, যা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বমূলক একটি সংগঠন। সাধারণত এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া, প্রতিনিধি নির্বাচন ও কার্যক্রম সামলাতে কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়।
রাকসু নির্বাচনের ইতিহাস-
(সংক্ষেপে রাকসু নামে পরিচিত) হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সৎ, মেধাবী এবং দেশপ্রেমিক ছাত্র নেতৃত্ব তৈরির উদ্দেশ্যে ১৯৬২ সালে রাকসু প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯০ সালের পর থেকে প্রায় তিন দশক সংগঠনটির কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠার পরে ১৯৮৯ পর্যন্ত মোট ১৪ বার রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। পদাধিকারবলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রাকসু -এর সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সদস্যরা সরাসরি ভোট দিয়ে সহ-সভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এবং অন্যান্য পদ নির্বাচন করেন। রাকসু সূত্রে জানা যায়, বিশ শতকে সর্বশেষ ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে রুহুল কবির রিজভী আহমেদ ও রুহুল কুদ্দুস বাবু এক বছরের জন্য যথাক্রমে ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়, ১৯৭০ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এছাড়া সামরিক শাসনের জন্য ১৯৭৫-১৯৮০ এবং ১৯৮১-১৯৮৮ সাল পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত ছিল। ১৯৮৯ সাল এর পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত রাকসু নির্বাচন স্থগিত ছিল। ২৪ শের গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ কার্যকর করার দাবি উঠলে রাকসু নির্বাচনেরও দাবি জানাতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০২৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করে তফসিল ঘোষণা করে। পরবর্তীতে এই তারিখ পিছিয়ে দেওয়া, ফলে ২০২৫ সালের ১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় রাকসুর ১৫ তম নির্বাচন।
ভোটগ্রহণ ও নির্বাচন প্রক্রিয়া-
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনে ২৩টি পদের মধ্যে ২০টিতেই জয় পেয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল। বাকি তিনটি পদে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাহউদ্দিন আম্মার (জিএস), ক্রীড়া সম্পাদক পদে নার্গিস আক্তার এবং বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক পদে তোফায়েল আহমেদ তোহা। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক সেতাউর রহমান রাকসু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করেন। শীর্ষ তিন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে না পেরে এ বিশ্ববিদ্যালয়েও ভরাডুবি হয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের।
দীর্ঘ ৩৪ বছর পর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) পদে ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’-এর মোস্তাকুর রহমান জাহিদ বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। তিনি পেয়েছেন ১২ হাজার ৬৮৭ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেলের শেখ নূর উদ্দীন আবির পেয়েছেন ৩ হাজার ৩৯৭ ভোট। ভোটের ব্যবধান দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ২৯০। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাহউদ্দিন আম্মার জয়ী হয়েছেন ১১ হাজার ৫৩৭ ভোট পেয়ে। তার নিকটতম শিবির সমর্থিত প্রার্থী ফজলে রাব্বি ফাহিম রেজা পেয়েছেন ৫ হাজার ৭২৯ ভোট। ব্যবধান দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৮০৮ ভোটে।
সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে শিবির সমর্থিত সালমান সাব্বির ৬ হাজার ৯৭১ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, ছাত্রদল সমর্থিত জাহিন বিশ্বাস এষা পেয়েছেন ৫ হাজার ৯৪১ ভোট। ব্যবধান মাত্র ১ হাজার ৩০ ভোট। রাকসুর ২৩ পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ২৪৭ জন প্রার্থী। এছাড়া হল সংসদের ১৫ পদে ১৭টি হলে ৫৯৭ জন এবং সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের ৫ পদে ৫৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।এর আগে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯টি একাডেমিক ভবনের ১৭টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। দিনভর অভিযোগ–বিক্ষোভের পর রাতে কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে ভোট গণনা শুরু হয় এবং ধাপে ধাপে ফলাফল ঘোষণা করা হয়।
নির্বাচনে মোট ভোটার ছিলেন ২৮ হাজার ৯০১ জন। এর মধ্যে ছাত্র ভোটার ১৭ হাজার ৫৯৬ এবং ছাত্রী ভোটার ১১ হাজার ৩০৫ জন। ভোট পড়েছে ৬৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ছয়টি নারী হলে ভোট পড়ার হার ছিল ৬৩ দশমিক ২৪ শতাংশ।
ঘোষিত ফলাফলের পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উৎসবমুখর পরিবেশ দেখা যায়। দীর্ঘ বিরতির পর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক চর্চার নতুন সূচনা।
কেন এমন জয়?: কারণ ও বিশ্লেষণ-
রাকসু নির্বাচনে শিবিরের ব্যাপক জয় এসেছে কয়েকটি সুস্পষ্ট কারণে।
- শিবির দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসে সংগঠিতভাবে কাজ করে আসছে। তারা শিক্ষার্থীদের নানাবিধ সমস্যায় পাশে থেকেছে, যা তাদের প্রতি আস্থা তৈরি করেছে। প্রচারণায়ও তারা ছিল অত্যন্ত সক্রিয় ও পরিকল্পিত।
- বিরোধী প্যানেলগুলোর মধ্যে সংগঠনগত দুর্বলতা এবং প্রচারণায় সমন্বয়ের অভাব ছিল। এতে করে শিবিরের প্যানেল এককভাবে সুবিধা নিতে পেরেছে।
- শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রবল। অনেকে নতুন নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা চেয়েছে, যা শিবিরের প্রার্থীদের পক্ষে গেছে।
শেষ কথা-
এইবারের রাকসু নির্বাচন শুধুই একটা নির্বাচনের ঘটনাবলী ছিল না — এটি ক্যাম্পাস রাজনীতিতে একটি সংকেত দেয়। “রাকসু নির্বাচন- রাকসু নির্বাচনের ২৩ পদের ২০টিতেই শিবিরের জয়” এই বাক্যাংশ শুধু সংবাদ শিরোনাম নয়; এটি শিক্ষার্থীর প্রতিনিধিত্ব, সংগঠন ও রাজনীতির দিক পরিবর্তনের প্রতিফলন।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন-
প্রশ্ন ১: “রাকসু নির্বাচন- রাকসু নির্বাচনের ২৩ পদের ২০টিতেই শিবিরের জয়” মানে ঠিক কী?
উত্তর: এটি বোঝায় যে রাকসু-এর ২৩টি কেন্দ্রীয় পদে প্রতিযোগিতার পর শিক্ষার্থীর ভোটে ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেল ২০টি পদ জয় করেছে, যা নানাভাবে একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক মাইলফলক।
প্রশ্ন ২: শিবিরের জয় কতটা বিস্তৃত?
উত্তর: ২৩টি পদে ২০টিতে জয়লাভ করা হয়েছে শিবির-সমর্থিত প্যানেলের দ্বারা। এই যদি বিশ্লেষণ করা হয়, এটি শিক্ষার্থীর রাজনৈতিক সংগঠন ও অংশগ্রহণের শক্তিকে ইঙ্গিত করে।
প্রশ্ন ৩: নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ছিল?
উত্তর: আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন পরিচালনা করা হয়েছে, তবে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কিছু অভিযোগ ও বিতর্কও দেখা গেছে। ফলাফল-ঘোষণার পর সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ রয়েছে।
প্রশ্ন ৪: এই ফলাফল শিক্ষার্থীদের জন্য কি পরিবর্তন আনবে?
উত্তর: যদি নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীর দাবিগুলো বাস্তবায়ন করে, তাহলে এটি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীর অধিকার ও প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর দিকে একটি ইতিবাচক ধাবক হতে পারে।