মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য ‘মুক্তবাংলা’ – ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের গৌরবগাঁথার প্রতীক

ভাস্কর্য 'মুক্তবাংলা'

ভূমিকা-

বাংলাদেশের গর্বিত ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী প্রতীক হলো মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য ‘মুক্তবাংলা’। এটি শুধুমাত্র একটি ভাস্কর্য নয়, বরং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণকারী একটি জীবন্ত দলিল। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার কেন্দ্রে অবস্থিত এই ভাস্কর্যটি ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক ও সাধারণ দর্শনার্থীদের ইতিহাস জানার এক অসাধারণ সুযোগ করে দেয়।

ইতিহাসের পটভূমি-

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। এ যুদ্ধে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হন এবং লাখো নারী নির্যাতনের শিকার হন। এই ত্যাগ ও সংগ্রামকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য সারাদেশে বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘মুক্তবাংলা’ একটি ব্যতিক্রমী ভাস্কর্য যা শুধুমাত্র শহীদদের স্মরণ করে না, বরং মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবেও কাজ করে।

ভাস্কর্যটি ১৯৯৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবসে উদ্বোধন করা হয়।

অবস্থান ও যাতায়াত ব্যবস্থা-

মুক্তবাংলা ভাস্কর্যটি কুষ্টিয়া জেলার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত।

  • নিকটতম শহর: কুষ্টিয়া
  • ঢাকা থেকে দূরত্ব: প্রায় ২৩০ কিলোমিটার
  • যাওয়ার উপায়:
    • বাসে: ঢাকা থেকে কুষ্টিয়াগামী বাস সহজলভ্য।
    • ট্রেনে: পরদহ স্টেশন সবচেয়ে কাছের রেলস্টেশন।
    • স্থানীয়ভাবে রিকশা বা সিএনজি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া যায়।

স্থাপত্য ও নকশার বৈশিষ্ট্য-

প্রখ্যাত শিল্পী মাহমুদুল হাসান শুভ এর পরিকল্পনায় নির্মিত এই ভাস্কর্যটি মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি দিককে শিল্পের ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছে।

প্রধান বৈশিষ্ট্য:

  • আকার: ত্রিভুজাকৃতির প্রিজম
  • উচ্চতা: আনুমানিক ৫০ ফুট
  • উপাদান: ইট, সিমেন্ট ও মোজাইক
  • প্রতিপাদ্য: মুক্তিযুদ্ধের ৭টি সেক্টরের প্রতিচ্ছবি

প্রতীকসমূহ:

  • রাইফেল ও বেয়োনেট: প্রতিরোধের প্রতীক
  • লাল সূর্য: স্বাধীনতার উদয় ও রক্তের প্রতীক
  • বই ও কলম: বুদ্ধিজীবীদের অবদান
  • লাঙল ও গিয়ার: কৃষক ও শ্রমিকদের ভূমিকা
  • নারীচিত্র: নারীর সাহসিকতা ও সহযোদ্ধা হিসেবে অবস্থান

প্রতিটি দিকের দেয়ালে মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন ভিন্ন দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে – যেমন উদ্বাস্তু জীবন, নারী নির্যাতন, যুদ্ধের কৌশল ইত্যাদি।

শিক্ষামূলক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব-

মুক্তবাংলা শুধু একটি ভাস্কর্য নয়; এটি একটি শিক্ষাকেন্দ্রিক ও সাংস্কৃতিক স্থান হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত। এখানে প্রতি বছর বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষাসফরে আসে।

  • দর্শনার্থী গাইড: ইতিহাস বিভাগ থেকে ছাত্ররা স্বেচ্ছায় দর্শনার্থীদের তথ্য সরবরাহ করে।
  • সেমিনার ও আলোচনা: মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক আলোচনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ সভা।
  • কবিতা পাঠ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: জাতীয় দিবসগুলোতে বিশেষ আয়োজন।

সামাজিক প্রভাব-

মুক্তবাংলা ভাস্কর্যটি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে সহায়তা করছে। এটি কেবল অতীতের স্মৃতি নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য চেতনার বাতিঘর হিসেবে বিবেচিত।

  • শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করে
  • স্থাপত্যশিল্পে উদ্ভাবনী চিন্তাধারা অনুপ্রাণিত করে
  • সাধারণ মানুষকে ইতিহাস সচেতন করে তোলে

বিশেষ দিবসে মুক্তবাংলায় কার্যক্রম

মুক্তবাংলা প্রাঙ্গণে জাতীয় দিবস ও বিশেষ অনুষ্ঠানে নিম্নলিখিত কার্যক্রম হয়:

  • ২৬ মার্চ (স্বাধীনতা দিবস): পুষ্পস্তবক অর্পণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
  • ১৬ ডিসেম্বর (বিজয় দিবস): কুচকাওয়াজ, ক্যান্ডেল মার্চ
  • ২১ ফেব্রুয়ারি (আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস): ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা

দর্শনার্থীদের অভিজ্ঞতা-

মুক্তবাংলা ভাস্কর্য পরিদর্শনের সময় দর্শনার্থীরা পায়:

  • নিরিবিলি পরিবেশ
  • ছায়াঘেরা পথ ও বসার স্থান
  • ছবি তোলার সুযোগ
  • ভাস্কর্যের পাশে ব্যাখ্যাসহ ফলক

ঘুরে দেখার শ্রেষ্ঠ সময়-

মুক্তবাংলা ভাস্কর্য পরিদর্শনের জন্য শ্রেষ্ঠ সময় হলো শীতকাল (নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি)। বিশেষ করে ১৬ ডিসেম্বর (বিজয় দিবস) বা ২৬ মার্চ (স্বাধীনতা দিবস) এর দিনগুলোতে ভাস্কর্যটির চারপাশ বিশেষভাবে সজ্জিত থাকে।

উপসংহার-

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য ‘মুক্তবাংলা’ কেবল একটি শিল্পকর্ম নয়, বরং একটি জাতির আত্মত্যাগ, গৌরব ও সংগ্রামের প্রতীক। এটি আমাদের নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস জানার পাশাপাশি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক, পর্যটক—সকলের জন্য এটি এক অনন্য স্থান।

বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ভালোবাসলে, অবশ্যই একবার ভ্রমণ করুন ‘মুক্তবাংলা’—যেখানে প্রতিটি ইটে লেখা আছে বীরত্বগাথা।

প্রশ্নোত্তর-

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য ‘মুক্তবাংলা’ কী?
এটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে নির্মিত একটি ভাস্কর্য যা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ায় অবস্থিত।

ভাস্কর্যটির ডিজাইনার কে?
এই ভাস্কর্যটি পরিকল্পনা করেছেন শিল্পী মাহমুদুল হাসান শুভ।

এটি কবে উদ্বোধন করা হয়?
১৯৯৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর, বিজয় দিবসে।

এটি কোথায় অবস্থিত?
কুষ্টিয়া জেলার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।

ভাস্কর্যটি কী বোঝাতে চায়?
এটি মুক্তিযুদ্ধের ৭টি সেক্টর ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির অবদানকে প্রকাশ করে।

সাধারণ দর্শনার্থীরা কি এটি দেখতে যেতে পারেন?
হ্যাঁ, যে কেউ এটি দেখতে যেতে পারেন।

প্রবেশ ফি আছে কি?
না, প্রবেশ সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।

দেখার জন্য শ্রেষ্ঠ সময় কখন?
নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস এবং জাতীয় দিবসগুলোতে।

গাইডেড ট্যুর পাওয়া যায় কি?
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রায়ই স্বেচ্ছায় গাইড হিসেবে সাহায্য করে।

ভাস্কর্যটি কে রক্ষণাবেক্ষণ করে?
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটি রক্ষণাবেক্ষণ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top