প্রবাসীরা: পরিবারের পর দেশের কাছেও প্রতারিত! জুলাই আন্দোলনের অবদান ভুলে গেল সরকার
প্রবাসীরা আমাদের দেশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা বছরের পর বছর পরিশ্রম করে বিদেশে উপার্জিত প্রতিটি টাকা পরিবার ও দেশের অর্থনীতিতে ঢেলে দেন। একসময় প্রবাসীরা কেবল নিজেদের পরিবারের কাছেই প্রতারিত হতেন—যাদের কাছে অর্থ পাঠাতেন, সেই পরিবার অনেক সময় তাদের স্বপ্ন, সম্পদ ও সম্মান রক্ষা করতে ব্যর্থ হতো। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আজ সেই প্রবাসীরা দেশের কাছ থেকেও অবহেলার শিকার হচ্ছেন।
জুলাই আন্দোলনে প্রবাসীদের ভূমিকা
জুলাই আন্দোলনে প্রবাসীদের অবদান ছিল অনন্য। প্রবাসীরা কেবল আর্থিক সহায়তাই দেননি—তারা আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের আন্দোলনের খবর ছড়িয়ে দিয়েছেন, বিদেশি মিডিয়ায় প্রচার করেছেন এবং কূটনৈতিক মহলে চাপ সৃষ্টি করেছেন। বিশ্বের নানা প্রান্তে সমাবেশ, মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি আয়োজন করেছেন, যাতে দেশের ন্যায়সংগত দাবি বিশ্ববাসীর সামনে পৌঁছায়।
তাদের অর্থ, সময়, শ্রম—সবকিছু ছিল দেশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য উৎসর্গিত। অনেকে চাকরির ঝুঁকি নিয়েও আন্দোলনের পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন।
সরকারের অবহেলা ও কৃতজ্ঞতার অভাব
দুঃখের বিষয়, আন্দোলনের পর সরকার প্রবাসীদের সেই অবদানকে সম্মান দেওয়ার পরিবর্তে প্রায় উপেক্ষা করে গেছে। কোনো সরকারি সংবর্ধনা, স্বীকৃতি বা বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়নি। বরং অনেক সময় প্রবাসীরা রাষ্ট্রীয় সেবায় বৈষম্য, জটিল কাগজপত্র, ব্যাংক লেনদেনের ঝামেলা, এবং বিনিয়োগে নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হচ্ছেন।
এই অবহেলা শুধু প্রবাসীদের মন ভেঙে দেয় না, বরং দেশের প্রতি তাদের বিশ্বাসও দুর্বল করে দেয়।
প্রবাসীদের অবদান শুধু অর্থনৈতিক নয়
আমরা ভুলে যাই যে প্রবাসীরা শুধু রেমিট্যান্স পাঠান না, তারা বাংলাদেশের সুনাম, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে বিশ্বে তুলে ধরেন। তাদের কণ্ঠ আন্তর্জাতিক মহলে প্রভাব ফেলতে পারে—যা জুলাই আন্দোলনে স্পষ্ট দেখা গেছে।
যদি রাষ্ট্র তাদের অবদান স্বীকার না করে, তবে ভবিষ্যতে দেশের সংকটকালে প্রবাসীদের একই রকম ঐক্য ও ত্যাগ আশা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
আমাদের দায়িত্ব
প্রবাসীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ শুধু আনুষ্ঠানিকতার বিষয় নয়, এটা নৈতিক দায়িত্ব। সরকার ও নাগরিক সমাজের উচিত—
-
জুলাই আন্দোলনে প্রবাসীদের অবদানকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া
-
তাদের বিনিয়োগ ও সম্পদ সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া
-
প্রবাসী সেবা খাতকে সহজ ও স্বচ্ছ করা
-
ভবিষ্যতের জাতীয় আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে মর্যাদা দেওয়া
প্রবাসীরা যদি মনে করেন যে দেশ তাদের ত্যাগ ভুলে গেছে, তবে তা দেশের জন্যই এক বড় ক্ষতি হবে।
প্রবাসীর কষ্ট: পরিবারকে টাকা পাঠিয়ে শেষে শূন্য হাতে ফেরা
প্রতিদিন লাখো বাংলাদেশি প্রবাসী বিদেশের মাটিতে কঠোর পরিশ্রম করেন। কেউ গরম মরুভূমিতে রোদে পুড়ে, কেউ ঠান্ডা দেশে বরফের মধ্যে কষ্ট করে, আবার কেউ ফ্যাক্টরি বা নির্মাণ কাজে দিন-রাত কাজ করে—শুধু পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। মাসের শেষে তারা পরিশ্রমের টাকা দেশে পাঠান, যেন পরিবারের সদস্যরা ভালোভাবে থাকতে পারে, বাড়ি-ঘর ঠিক করা যায়, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা হয়, বা জমি কেনা যায়।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, অনেক প্রবাসীর জীবনকাহিনি এক সময় এসে একই জায়গায় মিলে যায়—দেশে ফেরার পর তারা বুঝতে পারেন, পরিবারের জন্য পাঠানো টাকায় তৈরি সম্পদ বা সঞ্চয় আর তাদের হাতে নেই।
কেন ঘটে এই পরিস্থিতি?
-
অতিরিক্ত আস্থা ও নিয়ন্ত্রণহীনতা
প্রবাসীরা পরিবারের প্রতি অগাধ বিশ্বাস রেখে সব অর্থ পাঠান, কিন্তু নিজে সেই অর্থ ব্যবহারের ওপর তদারকি করতে পারেন না। ফলে অনেক সময় টাকা অন্য কাজে খরচ হয়ে যায়। -
অপচয় ও বিলাসী জীবন
হঠাৎ হাতে বেশি টাকা পেলে অনেক পরিবারের জীবনযাত্রা বদলে যায়। তারা অতিরিক্ত খরচ শুরু করে, যা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির কারণ হয়। -
জমি-বাড়ি বিক্রি বা আত্মসাৎ
কিছু ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা প্রবাসীর নামে কেনা সম্পত্তি বিক্রি করে দেন, বা নিজেদের নামে লিখে নেন, ফলে প্রবাসী দেশে ফিরলে আর কিছুই পান না। -
ঋণ শোধ ও অন্যের দায়িত্ব নেওয়া
প্রবাসীর পাঠানো টাকা দিয়ে আত্মীয়স্বজনের ঋণ শোধ করা হয় বা এমন খাতে খরচ হয় যা কোনো সঞ্চয় গড়ে তোলে না।
প্রবাসীর মনোযন্ত্রণা
দেশে ফেরার পর যখন দেখা যায় নিজের নামে কোনো সম্পদ নেই, তখন সেই কষ্ট শুধু আর্থিক নয়, মানসিকভাবেও ভীষণ আঘাত দেয়। অনেকে আবার জীবনের শেষ বয়সে এসে বিদেশে ফিরে যেতে বাধ্য হন, কারণ দেশে টিকে থাকার মতো কোনো অবলম্বন তাদের হাতে থাকে না।
সমাধানের উপায়
✅ টাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা – ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিজের নামে রাখা ও অনলাইন লেনদেন ব্যবহার করা।
✅ বিশ্বাসযোগ্য ম্যানেজমেন্ট – পরিবারের পাশাপাশি নির্ভরযোগ্য বন্ধু বা আত্মীয়ের মাধ্যমে সম্পদ পরিচালনা করা।
✅ আইনগত নিরাপত্তা – জমি বা সম্পত্তি নিজের নামে রেজিস্ট্রি করা।
✅ বিনিয়োগ পরিকল্পনা – দীর্ঘমেয়াদী সঞ্চয় বা বিনিয়োগে টাকা রাখা, যাতে হঠাৎ কেউ তা ব্যবহার করতে না পারে।
শেষ কথা
প্রবাসীরা শুধু পরিবারের জন্য নয়, দেশের অর্থনীতির জন্যও রক্ত-ঘাম ঝরান। তাই তাদের উপার্জিত টাকার সঠিক ব্যবহার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। নইলে “সব পাঠিয়ে শেষে শূন্য হাতে ফেরা”—এই দুঃখের গল্প চলতেই থাকবে।