পিআর পদ্ধতি বা অনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা কী?-
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর হচ্ছে নির্বাচনি ব্যবস্থার এমন একটি পদ্ধতি যেখানে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি কোন দল মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ১০ শতাংশ পায়, তাহলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি আসন পাবেন।
পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুক্ত, গোপন ও মিশ্র তিনটি আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। কোনো দল নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তারা সেই অনুপাতে আসন পাবে, নির্বাচনের এই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি যদি চালু হয় তাহলে তা সুশাসন নিশ্চিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, এ পদ্ধতিতে একটি নির্বাচনে দেওয়া প্রত্যেকটি ভোট কাজে লাগে এবং প্রতিটি ভোট সংসদে সমানভাবে প্রতিনিধিত্ব করে। তাছাড়া একটি নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা ও হারের ভিত্তিতে সংসদে আসন বণ্টন হয়। অনেক সময় খুব সামান্য পার্থক্য থাকলেও অনেক দল সংসদে একটি আসনও পায় না। কিন্তু এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে তাতে নূন্যতম ভোট পেলে সব রাজনৈতিক দলেরই প্রতিনিধিত্ব থাকার সুযোগ রয়েছে সংসদে । বর্তমানে বিশ্বের বহু উন্নত দেশ যেমন সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, ইসরায়েল ও জার্মানি এই পদ্ধতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশের মতো দেশেও পিআর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা চলছে বিশেষ করে ভোটাধিকারের সুবিচার ও সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার প্রশ্নে।
প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থার সাথে পার্থক্য কী?-
বর্তমান বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় ৩০০টি আসনে আলাদা আলাদা প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে রাজনৈতিক দলগুলো। ধরা যাক, বর্তমান পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে একটি আসনে মোট চারজন প্রার্থী চারটি দল থেকে নির্বাচন করছে। এই নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৮৫ শতাংশ।
এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তিনজন প্রার্থীই ২০ শতাংশ করে ভোট পেল। আর চতুর্থ প্রার্থী পেলো ২৫ শতাংশ ভোট। বর্তমান পদ্ধতি অনুযায়ী চতুর্থ প্রার্থীই এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। আর ওই তিনটি দলের ৬০ শতাংশ ভোট তেমন কোন কাজে আসছে না। একই ভাবে সারাদেশের অন্তত ২৯০ আসনে যদি একই হারে ভোট পেয়ে চতুর্থ দলটির প্রার্থীরা জয়লাভ করে, তাহলে মাত্র ২৫ শতাংশ ভোট নিয়ে তারা সরকার গঠনসহ সংসদে একচ্ছত্রভাবে আধিপত্য করবে। অথচ বাকি তিন দল মিলে ৬০ শতাংশ ভোট পেলেও তাদের কোন প্রতিনিধিত্ব থাকলো না সংসদে। এতে সংসদে প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণ থাকে না। এই পদ্ধতিতে ভোট হলে নিজস্ব ভোট ব্যাংকে কাজে লাগিয়ে বা স্থানীয় ইমেজ কাজে লাগিয়ে কেউ জিতে সরকার গঠন করতে পারে। সেক্ষেত্রে অনেক সময় মেজরিটি ভোটারে মতের প্রতিফলন হয় না। আর আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিতে ভোটের আগে প্রতিটি দল ক্রম ভিত্তিতে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল তার প্রাপ্ত ভোটের হার অনুসারে আসন সংখ্যা পাবে।
পিআর পদ্ধতির ধরণসমূহ–
পিআর পদ্ধতির আবার কয়েকটি ভিন্ন ধরণ আছে। সেগুলো নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
১. পার্টি-লিস্ট পিআর (Party-List PR)
এই পদ্ধতিতে ভোটাররা কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীকে নয়, একটি রাজনৈতিক দলকে ভোট দেন। দলসমূহ পূর্বে একটি প্রার্থীতালিকা জমা দেয় এবং প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে তালিকা অনুসারে প্রার্থীরা নির্বাচিত হন।
২. মিশ্র পিআর (Mixed-Member Proportional – MMP)
এই পদ্ধতিতে ভোটার দুটি ভোট প্রদান করেন—একটি নির্দিষ্ট প্রার্থীর জন্য এবং অন্যটি একটি দলের জন্য। কিছু আসন সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় এবং বাকিগুলো পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে পূরণ হয়।
৩. সিঙ্গেল ট্রান্সফারেবল ভোট (Single Transferable Vote – STV)
এই ধরণের পিআর পদ্ধতিতে ভোটাররা প্রার্থীদের পছন্দক্রম অনুযায়ী র্যাঙ্ক করেন। নির্দিষ্ট কোটা পূরণ হলে প্রার্থীরা নির্বাচিত হন। এটি সাধারণত ছোট আকারের দলগুলোর জন্য উপযোগী।
পিআর পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য-
- ভোট ও আসনের সামঞ্জস্য: ভোটের শতাংশ ও আসনের শতাংশের মধ্যে একটা সরাসরি সম্পর্ক থাকে।
- সংখ্যালঘু ও ছোট দলগুলোর জন্য উপকারী: ছোট দল ও কমসংখ্যক ভোটার বিশিষ্ট গোষ্ঠীগুলো সংসদে প্রতিনিধিত্ব পায়।
- ভোট অপচয় কমে: একটি দল ৫% ভোট পেলেও সংসদে আসন পেতে পারে, যা FPTP পদ্ধতিতে সম্ভব নয়।
- বৃহত্তর জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয়: সমাজের বিভিন্ন মতাদর্শ ও শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়।
পিআর পদ্ধতির সুবিধাসমূহ-
-
জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটে।
-
সংখ্যালঘুদের ও নারীদের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি পায়।
-
ছোট দলগুলোর উদ্ভব ও অংশগ্রহণ বাড়ে।
-
রাজনৈতিক বহুত্ববাদ ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়।
-
রাজনৈতিক জোট গঠন ও সমঝোতার সুযোগ বৃদ্ধি পায়।
পিআর পদ্ধতির অসুবিধাসমূহ-
- সরকার গঠনে বিলম্ব হতে পারে।
- অস্থিতিশীলতা ও জোট সরকারের ভঙ্গুরতা।
- দলীয় শৃঙ্খলা ও নেতৃত্বের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা।
- ভোটার-প্রতিনিধির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক দুর্বল হয়।
- বেশি সংখ্যক দল সংসদে প্রবেশ করলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে জটিলতা বাড়ে।
পিআর পদ্ধতির প্রাসঙ্গিকতা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে-
বাংলাদেশ বর্তমানে ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট (FPTP) পদ্ধতি অনুসরণ করে, যেখানে সর্বাধিক ভোট প্রাপ্ত প্রার্থী বিজয়ী হন। কিন্তু এতে অনেক ভোট অপচয় হয় এবং জনমতের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটে না।
পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে:
- সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর শোনা যায়।
- ছোট দলগুলোর রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা বাড়ে।
- রাজনৈতিক সহনশীলতা ও বহুত্ববাদ বিকাশ লাভ করে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে বৈচিত্র্য আনার জন্য আংশিক পিআর পদ্ধতির বিবেচনা করা যেতে পারে।
কোন দেশগুলো পিআর পদ্ধতি ব্যবহার করে?-
দেশ | ব্যবহারকৃত পদ্ধতি |
---|---|
সুইডেন | পার্টি-লিস্ট পিআর |
জার্মানি | মিশ্র পিআর |
ইসরায়েল | পার্টি-লিস্ট পিআর |
নেদারল্যান্ডস | পার্টি-লিস্ট পিআর |
দক্ষিণ আফ্রিকা | পার্টি-লিস্ট পিআর |
FPTP বনাম পিআর পদ্ধতি: তুলনামূলক বিশ্লেষণ-
বৈশিষ্ট্য | FPTP | পিআর পদ্ধতি |
---|---|---|
ভোটের প্রতিফলন | আংশিক | সম্পূর্ণ |
ছোট দল | প্রায় বাদ পড়ে | অন্তর্ভুক্ত হয় |
ভোট অপচয় | অনেক | কম |
সরকার গঠন | সহজ | জোট ভিত্তিক |
রাজনৈতিক বৈচিত্র্য | কম | বেশি |
ভবিষ্যতের করণীয় ও সংস্কার সম্ভাবনা-
বাংলাদেশে ধাপে ধাপে পিআর পদ্ধতির প্রয়োগ হতে পারে:
- সংরক্ষিত আসনে পিআর পদ্ধতি।
- মিশ্র পদ্ধতির প্রয়োগ (FPTP + পিআর)।
- পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রয়োগ।
এতে করে ধীরে ধীরে জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে।
উপসংহার-
পিআর পদ্ধতি বা অনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি জনমতের যথাযথ প্রতিফলন নিশ্চিত করে, রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি করে এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ সংসদ গঠনে সহায়তা করে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পিআর পদ্ধতির ব্যবহার বা অন্ততঃ আংশিক প্রয়োগ বিবেচনার দাবি রাখে। একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে এই পদ্ধতি একটি সম্ভাব্য পথ।
প্রশ্নোত্তর-
- পিআর পদ্ধতি কী?
-পিআর (Proportional Representation) পদ্ধতি একটি নির্বাচন ব্যবস্থা যেখানে ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন করা হয়।
- বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি আছে কি?
-না, বাংলাদেশ বর্তমানে FPTP পদ্ধতি ব্যবহার করে।
- পিআর পদ্ধতির সুবিধা কী?
-জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটে, সংখ্যালঘু ও ছোট দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়।
- পিআর পদ্ধতির অসুবিধা কী?
-সরকার গঠনে বিলম্ব, জোট সরকারের অস্থিতিশীলতা, ও দলীয় নিয়ন্ত্রণ বেশি।
- কোন দেশগুলো পিআর পদ্ধতি ব্যবহার করে?
-সুইডেন, জার্মানি, ইসরায়েল, নেদারল্যান্ডস প্রভৃতি।
- পিআর পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত কি?
-রাজনৈতিক বৈচিত্র্য, অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধি নির্বাচনে ভারসাম্য আনতে এটি উপযুক্ত বিকল্প হতে পারে।