নেপাল সরকারের পতন: ভূমিকা-
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কিছু নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকট থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বাংলাদেশে নানা সময়ে গণআন্দোলন, এবং এখন নেপালে সরকারের পতন—সবই এই অঞ্চলের জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনা ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে স্পষ্ট করে তুলেছে।
নেপাল সরকারের পতন কেবল একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনা নয়, বরং এটি একটি আঞ্চলিক সতর্কবার্তা। জনগণ তাদের মৌলিক অধিকার, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসনের জন্য যখন রাস্তায় নামে, তখন সরকার টিকে থাকতে পারে না। এই প্রেক্ষাপটে অনেকেই বলছেন—নেপাল যেন শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের পথে হাঁটছে।
(বাংলাদেশে সামাজিক আন্দোলন ও তরুণ প্রজন্ম: প্রভাব, সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ)
নেপাল সরকারের পতনের প্রেক্ষাপট-
-
রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘদিন ধরেই নেপালের রাজনীতিতে বিদ্যমান।
-
দলীয় কোন্দল, দুর্নীতি, স্বচ্ছ নেতৃত্বের অভাব—সবকিছু মিলেই পরিস্থিতি জটিল করেছে।
-
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নেপাল মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। বেকারত্ব বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, এবং জনজীবনে দুর্ভোগ চরমে উঠেছে।
এই প্রেক্ষাপটে জনগণের বিক্ষোভ, আন্দোলন ও অনাস্থার কারণে নেপালের সরকার পতন ঘটে।
নেপাল সরকারের পতনের কারণ-
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকেও হিমালয়ের চূড়া দেখা যায়। কিন্তু সেখানকার রাজনৈতিক আকাশ প্রায়শই কালো মেঘে ঢাকা থাকে।
গত কয়েক বছরে নেপালে একাধিকবার সরকার পতন হয়েছে, যা বাইরের পর্যবেক্ষকদের কাছে এক ধাঁধার মতো মনে হতে পারে। এক সময় রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই করে দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু গণতন্ত্রের সেই পথ বারবার বিক্ষোভ, অবিশ্বাস ও সরকার পতনের মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাস, সামাজিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক সংকটের গভীরে প্রবেশ করতে হবে।
নেপালের রাজনৈতিক পটভূমি বোঝার জন্য কয়েক দশক পেছনে ফেরা যাক। দেশটিতে দীর্ঘ সময় ধরে শাহ রাজবংশের নিরঙ্কুশ শাসন ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঢেউ লাগে। এই আন্দোলন ‘জন আন্দোলন’ বা ‘পিপলস মুভমেন্ট’ নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে ১৯৯০ সালে একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে রাজা সীমিত ক্ষমতার অধিকারী হন। তবে এই পরিবর্তন স্থায়ী হয়নি।
২০০৬ সালে নেপালের রাজনীতিতে আসে বড় মোড়। দীর্ঘদিন ধরে সশস্ত্র সংগ্রাম চালানো মাওবাদী বিদ্রোহী ও মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো একত্রিত হয়ে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন পরিচিত ‘জন আন্দোলন-২’ নামে। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল রাজতন্ত্রের অবসান এবং একটি পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। আন্দোলনের ফলে ২০০৮ সালে রাজতন্ত্রের চূড়ান্ত অবসান ঘটে এবং নেপাল একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
আল জাজিরার তথ্য, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরও ২০০৮ থেকে এ পর্যন্ত নেপালে ১৩ বার সরকার বদল হয়েছে। এগুলোর পেছনে আছে একাধিক জটিল কারণ। যেগুলো ব্যাখ্যা করা যাক কয়েকটি ধাপে।
ভারত-চীনের প্রভাব ও রাজতন্ত্রে ফেরার বাসনা- ভূ-রাজনৈতিকভাবে নেপাল অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি অঞ্চলের দেশ। এর উত্তরে চীন ও দক্ষিণে ভারত। উভয়ই বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তি। এই দুটি দেশের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে।
ত্রিভূবন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শান্ত বাহাদুর থাপা তাঁর গবেষণায় লিখেছেন, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত ও চীন উভয়ই নেপালে তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থ রক্ষা করে চলে। নেপালের পররাষ্ট্রনীতিও ঐতিহাসিকভাবে নিজেদের জাতীয় স্বার্থ, ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রতিবেশী দুই দেশের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
থাপা লিখেছেন, নেপালের রাজনৈতিক বিষয়ে ভারতের সম্পৃক্ততা বিতর্কিত একটি বিষয়। কারণ এটি প্রায়ই সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সম্ভাব্য দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়। অপরদিকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর মাধ্যমে চীন ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে। চীন নেপালকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে এবং অনেক রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করেছে। এর ফলে নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের উপস্থিতিও বেড়েছে।
ত্রিভূবন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক লিখেছেন, ভারত ও চীনের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নেপালের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। উভয় দেশই এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। কৌশলগত লক্ষ্য অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ভারত বা চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে আরও জটিল করেছে।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা-নেপালে সরকার প্রায়ই অস্থির জোটের ওপর নির্ভরশীল থাকে। এই জোটের ভাঙনই সরকার পতনের প্রধান কারণগুলোর একটি।
দুর্নীতি-রাজনীতিতে দুর্নীতি ও জবাবদিহিতার অভাব জনগণকে হতাশ করেছে।
অর্থনৈতিক সংকট-অর্থনীতির ওপর বৈদেশিক ঋণের চাপ, কর্মসংস্থানের অভাব এবং মূল্যস্ফীতি জনগণের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে।
জনগণের অসন্তোষ-শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মৌলিক চাহিদা পূরণে সরকারের ব্যর্থতা জনগণকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে।
নেপাল কী শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের পথেই হাঁটছে?-
-
অর্থনীতি: শ্রীলঙ্কার মতো ঋণের বোঝা ও মূল্যস্ফীতি নেপালকেও বিপর্যস্ত করেছে।
-
রাজনীতি: বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক বিভাজন ও আন্দোলন নেপালকেও গ্রাস করছে।
-
জনগণের প্রতিক্রিয়া: তিন দেশের জনগণই প্রতিবাদ ও আন্দোলনের মাধ্যমে পরিবর্তন চেয়েছে।
তাই বলা যায়—নেপালের সরকার পতন কেবল স্থানীয় ঘটনা নয়, বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক প্রবণতারই প্রতিফলন।
জেন-জি’রা যা করল-
সম্প্রতি নেপালে ক্ষমতাসীন দলগুলোর মন্ত্রী ও নেতাদের ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসে। যেগুলো ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। বিশ্লেষকদের ধারণা, সরকারের বিরুদ্ধে এসব প্রচার বন্ধ করতেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়।
কে পি শর্মা অলির সরকার নিজেদের অনিয়ম ঢাকতে চাইলেও ফেসবুক, ইউটিউবের ওপর নিষেধাজ্ঞা লাখো নেপালির রুটি-রুজির ওপর সরাসরি আঘাত হানে। দেশটির ২০ শতাংশের বেশি বেকার তরুণ সামাজিক মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল। খবর, বিনোদনের পাশাপাশি অনেকে এসব মাধ্যম থেকে আয় করেন। যা তাদের স্বার্থে সরাসরি আঘাত হানে। ফলাফল ক্ষোভে ফেটে পড়ে তরুণরা। দুই দিনের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হন কে পি শর্মা।
জনগণের আন্দোলন: গণতন্ত্রের রূপকথা না বাস্তবতা?-
নেপালের জনগণের আন্দোলন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—গণতন্ত্র কেবল কাগজে-কলমে নয়, বরং জনগণের হাতে এর আসল শক্তি নিহিত।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, সরকার পতনের পর নতুন সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে কি না। ইতিহাস বলছে—শুধু সরকার পতন যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন সুশাসন, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছ নেতৃত্ব।
উপসংহার-
নেপাল সরকারের পতন দেখিয়ে দিল যে জনগণই আসল শক্তির উৎস। যখন সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়, তখন মানুষ রাস্তায় নামে এবং ইতিহাস সৃষ্টি করে।
শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে—দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ আর অকার্যকর সরকার মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। নেপালের ঘটনাও সেই ধারাবাহিকতারই অংশ। এখন চ্যালেঞ্জ হলো—সরকার পরিবর্তনের পরও কীভাবে একটি স্থিতিশীল, স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায়।
প্রশ্নত্তের-
প্রশ্ন: নেপাল সরকারের পতন কেন ঘটল?
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক সংকট ও জনগণের অসন্তোষ এর মূল কারণ।
প্রশ্ন: নেপালের ঘটনায় শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের সঙ্গে কী মিল রয়েছে?
তিন দেশেই অর্থনৈতিক দুরবস্থা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জনগণের আন্দোলনের কারণে সরকার চাপে পড়েছে।
প্রশ্ন: নেপালের জনগণ কেন রাস্তায় নেমেছিল?
চাকরির অভাব, মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি ও মৌলিক চাহিদা পূরণে সরকারের ব্যর্থতা জনগণকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে।
প্রশ্ন: সরকার পতনের পর নেপালের ভবিষ্যৎ কী?
রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তবে স্বচ্ছ নেতৃত্ব ও অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
প্রশ্ন: এই অভিজ্ঞতা থেকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো কী শিখতে পারে?
সুশাসন, স্বচ্ছতা, জনগণের আস্থা অর্জন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অপরিহার্য।