নেপালের অন্তবর্তীকালীন সরকার-
নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্তবর্তীকালীন সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর, কেপি শর্মা ওলির সরকারের পতনের মাধ্যমে নতুন অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এই সরকার দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে। (নেপাল সরকারের পতন: নেপাল কী শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের পথেই হেঁটেছে??)
সুশিলা কার্কি: প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী-
২০২৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর, সুশিলা কার্কি নেপালের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ৭৩ বছর বয়সী সুশীলা হিমালয় কন্যাখ্যাত দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হলেন। দেশটির প্রথম প্রধান নারী বিচারপতিও ছিলেন তিনি। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় এক বছর তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণু’ অবস্থান নিয়ে আলোচিত ছিলেন তিনি। ওই অবস্থানের কারণেই এখন সরকার প্রধান হিসেবে তাঁর নাম প্রস্তাব করেন বিক্ষোভকারী তরুণেরা।
নেপালের অন্তবর্তীকালীন সরকারের পটভূমি-
নেপালে অন্তবর্তীকালীন সরকারের ধারণা দীর্ঘদিনের। গণতান্ত্রিক পরিবর্তন, সংবিধান প্রণয়ন, কিংবা রাজনৈতিক সংকটের সময়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। ২০২৫ সালের গণঅভ্যুত্থান দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত।
নেপালের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন দেশটির সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকি। গতকাল শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে নেপালে চলমান রাজনৈতিক সংকটের আপাত সমাধান হলো বলে আশা করা হচ্ছে।
সুশীলা কারকি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে আগামী ছয় মাসের মধ্যে দেশটিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবেন। তাঁর সঙ্গে তিন সদস্যের একটি মন্ত্রিপরিষদ দায়িত্ব পালন করবে বলে নেপালভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য হিমালয়ান টাইমস জানিয়েছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারা নতুন সরকারের মন্ত্রী হবেন, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এই পরিস্থিতিতে মন্ত্রীরা শপথ গ্রহণের আগপর্যন্ত সুশীলাই সব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করবেন। প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেওয়ার কিছুক্ষণ পর পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করেছেন সুশীলা কারকি।
কে পি শর্মার পদত্যাগ –
কে পি শর্মা অলি সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী যথাসময়ে নিবন্ধন না করায় ৪ সেপ্টেম্বর মধ্যরাত থেকে নেপালে ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটাকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার দেশটিতে বিক্ষোভ শুরু হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ শুরু হলেও জনগণের মধ্যে অসন্তোষের আরও অনেক কারণ ছিল। এসবের মধ্যে বেকারত্ব, দুর্নীতি, শাসকশ্রেণির সন্তানদের বিলাসী জীবন এবং ক্ষমতায় তরুণদের জায়গা না হওয়া অন্যতম।
ভারত আর চীনের মধ্যে নেপালের অবস্থান। দেশটিতে ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র শেষ হওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা চলছে। দেশে কর্মসংস্থানের অভাব। তাই লাখ লাখ মানুষ বিদেশে গিয়ে চাকরি করছেন এবং দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন।
মঙ্গলবার বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট ভবনে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ হয়। কাঁদানে গ্যাসের শেল, জলকামান ব্যবহারের একপর্যায়ে গুলি চালায় পুলিশ। প্রথম দিনের সংঘর্ষে ১৯ জন নিহত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী অলি পদত্যাগ করেন।
তবে এরপরও দেশটিতে সহিংসতা চলতে থাকে। ২০০৮ সালে গৃহযুদ্ধ ও রাজতন্ত্রের অবসানের পর নেপালে এই কয়েক দিনে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা ঘটে, যাতে গতকাল পর্যন্ত অন্তত ৫১ জন প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা গেছে।
তরুণদের বিক্ষোভের মুখে গত মঙ্গলবার নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি পদত্যাগ করার পর দেশটিতে রাজনৈতিক সংকট চলছিল। সংকট সমাধানে বিক্ষোভকারী তরুণদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করেন নেপালের প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাওদেল ও সেনাপ্রধান অশোক রাজ সিগদেল। গতকাল আলোচনায় মতৈক্য হওয়ার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুশীলা কারকির নাম ঘোষণা করে প্রেসিডেন্টের দপ্তর। বলা হয়, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সংবিধান সমুন্নত রাখতে এবং জাতীয় ঐক্য এগিয়ে নিতে সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে সুশীলা কারকিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট পাওদেল। এরপর গতকাল স্থানীয় সময় রাত নয়টার পরে নেপালের রাষ্ট্রপতির বাসভবন শীতল নিবাসে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন সুশীলা। প্রেসিডেন্ট পাওদেল তাঁকে শপথ পড়ান। ওই অনুষ্ঠানে নেপালের ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধান বিচারপতি, সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা ও বিদেশি কূটনীতিকেরা অংশ নেন।
উপসংহার-
নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসে নেপালের অন্তবর্তীকালীন সরকার সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংবিধান বাস্তবায়ন এবং সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতির সময় এই সরকার দেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। বর্তমান সময়ে সুশিলা কার্কির নেতৃত্বে গঠিত এই সরকার দেশকে নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করছে।
অন্তবর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম দেশের জন্য একটি মাইলফলক, যা ভবিষ্যতের স্থায়ী সরকারের জন্য মজবুত ভিত্তি গঠন করছে। নাগরিকদের অধিকার, সংবিধান বাস্তবায়ন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে মনোযোগ দিয়ে নেপালের অন্তবর্তীকালীন সরকার দেশের উন্নয়ন ও শান্তি নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ফলস্বরূপ, নেপালের অন্তবর্তীকালীন সরকার কেবল প্রশাসনিক কাজ সম্পাদন করছে না, বরং দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবেও কাজ করছে।
নেপালের অন্তবর্তীকালীন সরকার সম্পর্কে প্রশ্নত্তোর-
প্রশ্ন ১: নেপালের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য কী?
উত্তর: নেপালের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য হলো সংবিধান বাস্তবায়ন, সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ, রাজনৈতিক সংলাপ বৃদ্ধি এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
প্রশ্ন ২: সুশিলা কার্কি কে?
উত্তর: সুশিলা কার্কি নেপালের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। তিনি নেপালের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি।
প্রশ্ন ৩: নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্তবর্তীকালীন সরকারের ভূমিকা কী?
উত্তর: নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্তবর্তীকালীন সরকার দেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধান, সংবিধান প্রণয়ন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সূচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।