তুমুলিয়া গির্জা: গাজীপুরের ধর্মীয় ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল প্রতীক-
বাংলাদেশের ধর্মীয় সহনশীলতার নিদর্শন খুঁজতে গেলে আমরা নানান ধর্মের উপাসনালয়ের খোঁজ পাই — মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা এবং গির্জা। গাজীপুর জেলার St. John the Baptist Church, যা স্থানীয়ভাবে তুমুলিয়া গির্জা নামে পরিচিত, সেইরকম এক ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন।
এই গির্জাটি শুধু উপাসনার স্থান নয়, এটি একাধিক প্রজন্ম ধরে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও ঐক্যের প্রতীক হয়ে আছে। আজ এই ব্লগে আমরা জানব এর ইতিহাস, অবস্থান, স্থাপত্য, ধর্মীয় কার্যক্রম, ও দর্শনার্থীদের জন্য ভ্রমণ গাইড।
গির্জার পরিচিতি-
- নাম: St. John the Baptist Church
- প্রতিষ্ঠা: ১৮৪৪ সাল
- অবস্থান: Catholic Church, Toomilia, P.O. Kaliganj, Dist. Gazipur-1720
- পরিচালক পুরোহিত: Fr. Jacob S. Gomes
- সহকারী: Fr. Sagor Cruze
- ফোন: 06823-51458
- মোবাইল: 01851255402, 01878475908
- ইমেইল: frjsg010@gmail.com, sagardcruse@gmail.com
- খ্রিস্টান অনুসারী সংখ্যা: প্রায় ৫,৯০০+
এই গির্জাটি পরিচালনা করে বাংলাদেশের রোমান ক্যাথলিক চার্চ, এবং এটি গাজীপুরের একটি প্রাচীনতম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত।
ইতিহাস ও পটভূমি-
তুমিলিয়াতে কীভাবে কাথলিকদের বসতি গড়ে উঠে সে বিষয়ে লিখিত কোন সাক্ষ্য প্রমাণ বা নথিপত্র পাওয়া যায় না। মনে করা হয় যে নাগরীতে কাথলিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং আন্তইন দা রোজারিও-এর প্রচারের ফলে ক্রমশ তুমিলিয়া ও রাঙ্গামাটিয়ায় কাথলিক বসতি বিস্তার লাভ করে। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে তুমিলিয়া ও রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীস্থ কাথলিক গ্রামগুলো সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। পাঞ্জোরা থেকে যাজক গিয়ে গ্রামবাসীদের ধর্মীয় পরিচর্যা করতেন। ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত গির্জাটি ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দের প্রচণ্ড ঝড়ে ভূমিস্মাৎ হলে তা পরে পুনঃনির্মিত হয়।
১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ফাদার এমিল্ লাফোঁ, সিএসসি, তুমিলিয়াতে একতলা বিশিষ্ট নতুন ফাদার বাড়ি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে এটা সিস্টারদের জন্য দুতলা বিশিষ্ট দালানে পরিণত হয়। এ সময় শিক্ষার উপর অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফাদার জাঁ ফ্লুরী, সিএসসি-র সময়ে তুমিলিয়ায় পুরানো যাজক ভবনের সামনে একটি নতুন স্কুল তৈরি করা হয়। স্কুলটি ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে মিডিয়া ভের্নাকুলার স্কুলে পরিণত হয় এবং পরবর্তী বছরে সরকারী স্বীকৃতি পায়। সাধারণ খ্রিষ্টভক্তদের প্রশিক্ষণের জন্য তুমিলিয়াতে একটি ক্যাটেখিস্ট স্কুল এবং যাজক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা সেমিনারী চালু করা হয়। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে সেমিনারীটি বান্দুরায় সরিয়ে নেওয়া হয়।
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে যাজক ভবন নির্মাণ করা হয়। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে মেয়েদের জন্য একটি বোর্ডিং প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে পবিত্র ক্রূস সিস্টারদের পরিচালনায় দেশীয় সিস্টার পাওয়ার জন্য প্রেরিতগণের রাণী মারীয়ার সঙ্গিনী সিস্টারদের একটি প্রার্থীগৃহ ও পস্টুলেন্সী চালু হয়।
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে বালিকাদের জন্য একটি মিড্ল ইংলিশ স্কুল চালু হয়ে ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে হাইস্কুলে রূপান্তরিত হয়। সেইসময়ে পুরো পূর্ববাংলায় এটিই ছিলো মেয়েদের জন্য প্রথম হাই স্কুল। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে মাতৃসদন ও চিকিৎসালয়টি নির্মিত হয় যেটি বর্তমানে অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ নভেম্বর ফাদার গ্রেগরী স্টেগমায়ার, সিএসসি, তুমিলিয়ায় এসে সমাজ সংস্কারমূলক কাজ শুরু করেন। ফাদার আবেল বি. রোজারিও ও ফাদার যাকোব স্বপন গমেজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বর্তমানে তুমিলিয়াতে একটি সুন্দর নতুন গির্জা নির্মিত হয়েছে। তুমিলিয়াতে বর্তমানে কাথলিকদের সংখ্যা প্রায় ৫৯০৯ জন।
স্থাপত্য ও গঠনশৈলী-
গির্জাটির স্থাপত্যশৈলীতে রয়েছে গথিক ও ইউরোপীয় স্টাইলের প্রভাব। মূল ভবনটি লালচে ইটে তৈরি, যা অতীতের উপনিবেশিক ধাঁচের দৃষ্টান্ত।
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- সামনের অংশে ত্রিভুজাকৃতি গম্বুজের ডিজাইন
- মাঝখানে যীশু খ্রিস্টের বৃহৎ চিত্রকর্ম
- দুই পাশে ভার্জিন মেরি ও অন্যান্য ধর্মীয় চিত্র
- উপরে প্রধান ক্রুশচিহ্ন
- ঘণ্টা টাওয়ার এবং বড় জানালা
ভেতরে ঢুকলেই দেখা যায় কাঠের বেঞ্চ, মোমবাতি প্রজ্বলন স্থান, এবং সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো ধর্মীয় চিত্রকর্ম।
ধর্মীয় কার্যক্রম ও সামাজিক অবদান-
St. John the Baptist Church শুধু উপাসনার স্থান নয়, এটি একটি সামাজিক ও শিক্ষামূলক কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে।
-প্রতিদিন/সাপ্তাহিক প্রার্থনা
-বাপ্তিস্ম, বিবাহ ও সমাধি অনুষ্ঠান
-ধর্মীয় শিক্ষা ক্লাস
-গরীব-দুঃখীদের সহায়তা কার্যক্রম
-বড়দিন, ইস্টার, পাম সানডে ইত্যাদিতে বিশেষ প্রোগ্রাম
এটি একদিকে ধর্মীয় বিশ্বাসের কেন্দ্র, অন্যদিকে সামাজিক ঐক্য ও মানবিক সেবার কেন্দ্র।
চারপাশের পরিবেশ ও সৌন্দর্য-
তুমুলিয়া গির্জার চারপাশের পরিবেশ একদম শান্ত, পরিচ্ছন্ন এবং সবুজে ঘেরা। গির্জার সামনের বাগানটি সুন্দরভাবে গাছপালা ও ফুলে সজ্জিত। দৃষ্টিনন্দন এই গির্জাটি গ্রামের নিরিবিলি প্রকৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে আছে।
কিভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে গাজীপুর তুমুলিয়া গির্জা পৌঁছাতে:
- ঢাকা থেকে বাসে জয়দেবপুর বা কালিগঞ্জ পর্যন্ত আসুন
- সেখান থেকে সিএনজি/অটোতে তুমুলিয়া
- Google Maps-এ “St. John the Baptist Church, Toomilia” সার্চ দিলে সঠিক পথ দেখাবে
-দর্শনার্থীদের জন্য পরামর্শ
-শালীন পোশাক পরুন
-ধর্মীয় আচরণ বজায় রাখুন
-ছবি তোলার আগে অনুমতি নিন
-শান্তভাবে উপাসনালয় পরিদর্শন করুন
-বিশেষ দিনে গেলে আগে ফোন করে সময় জেনে নিন
কাছাকাছি দর্শনীয় স্থান
তুমুলিয়া গির্জা ঘুরতে গেলে আশপাশে ঘুরে দেখতে পারেন:
-ভাওয়াল রাজবাড়ি
-বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক
-নাওজোর চার্চ
-কপালেশ্বর মন্দির ও দীঘি
-শ্রীপুর চা বাগান
রক্ষণাবেক্ষণ ও ভবিষ্যৎ-
St. John the Baptist Church-এর মত প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনাগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ প্রয়োজন।
-ভবনের সংরক্ষণ
-ধর্মীয় সম্প্রীতির বার্তা ছড়ানো
-পর্যটনের সুযোগ তৈরি করা
-ধর্মীয় শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি
এই গির্জা শুধু অতীতের একটি স্মারক নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রেরণার উৎস।
উপসংহার-
তুমুলিয়া গির্জা (St. John the Baptist Church) শুধু একটি গির্জা নয়, এটি গাজীপুর জেলার ধর্মীয় ঐতিহ্য, ঐক্য এবং সৌহার্দ্যের প্রতীক। এর ১৮৪৪ সালের প্রতিষ্ঠা, স্থাপত্য, ধর্মীয় কার্যক্রম এবং শান্ত পরিবেশ একে করে তুলেছে গাজীপুরের এক নিঃসন্দেহে দর্শনীয় স্থান।
যদি তুমি একবার নিজে দেখতে যাও — গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে, চারপাশের নিঃশব্দ পরিবেশে নিঃশ্বাস নাও — তুমি অনুভব করবে সময় যেন এখানে থেমে গেছে, হৃদয়ে ছুঁয়ে যায় এক অনন্ত প্রশান্তি।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)-
প্রশ্ন ১: তুমুলিয়া গির্জা কোথায় অবস্থিত?
উত্তর: এটি গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার তুমুলিয়া গ্রামে অবস্থিত।
প্রশ্ন ২: গির্জাটি কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর: ১৮৪৪ সালে।
প্রশ্ন ৩: এখানে উপাসনার সময় কবে?
উত্তর: প্রতি রবিবার, এবং বড়দিন, ইস্টার সহ ধর্মীয় উৎসবগুলিতে।
প্রশ্ন ৪: গির্জায় প্রবেশ করতে টাকা লাগে কি?
উত্তর: না, প্রবেশ ফ্রি তবে অনুদান দেওয়া যায়।
প্রশ্ন ৫: অখ্রিস্টানরা গির্জায় প্রবেশ করতে পারে কি?
উত্তর: হ্যাঁ, যে কেউ শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রবেশ করতে পারে।
প্রশ্ন ৬: ছবি তোলা যাবে কি?
উত্তর: হ্যাঁ, তবে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে।