ছাত্রশিবিরের ডাকসু: ভূমিকা-
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্ররাজনীতি সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু হলো দেশের ছাত্ররাজনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু। এটি শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করে না, বরং দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনের দিকনির্দেশনায়ও প্রভাব ফেলে।
ডাকসুতে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন অংশ নেয়, এবং প্রতিবারের নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও প্রত্যাশা থাকে প্রবল। এর মধ্যে একটি আলোচিত সংগঠন হলো ছাত্রশিবির। দীর্ঘ সময় ধরে “ছাত্রশিবির ডাকসু” নিয়ে আলোচনা চলে আসছে—তাদের জনপ্রিয়তা, কার্যক্রম এবং প্রভাব সম্পর্কে। এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত বিশ্লেষণ করব – কেন ছাত্রশিবির ডাকসুতে জনপ্রিয়তা পেল, কেন শিবির না করেও ভিন্ন মতাদর্শীর শিক্ষার্থীরা তাদের প্যানেলে ও শিক্ষার্থীরা কেন তাদের পক্ষে ভোট দিলেন।
(জাকসু ফলাফলে বিলম্ব: জাকসু নির্বাচনের ফলাফলে কেন এত দেরি?)
ছাত্রশিবির ডাকসু জনপ্রিয়তা পাওয়ার কারণ-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ছাত্র শিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রায় নিরঙ্কুশ জয় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এবারই প্রথম এমন বিজয় অর্জন করল তারা। নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিজয়ীদের সাথে তাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর ভোটের দূরত্বও বেশ কয়েক হাজারের।
ডাকসুর ভিপি পদে জয়লাভ করা সাদিক কায়েমের সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খানের ভোটের ব্যবধান নয় হাজারেরও বেশি।
নির্বাচনের ফলাফল ঘাঁটলে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি পদের বিপরীতেই এই ব্যবধান লক্ষ্যণীয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিগত ২০ – ২৫ বছরের প্রকাশ্য ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্র শিবিরের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। প্রশ্ন উঠেছে, ছাত্রশিবিরের ডাকসু ও হল সংসদের এই বিজয়ে তাহলে কোন কোন ‘ফ্যাক্টর বা অনুঘটক‘ কাজ করেছে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ডাকসুর সাবেক ছাত্রনেতারা মনে করেন, জুলাই – অগাস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনা থেকে মাঠ পর্যায়ের সব নেতৃত্বে শিবিরই ছিল, এমন ন্যারেটিভই ডাকসু নির্বাচনে তাদের জয়লাভের অন্যতম একটি কারণ। বিশ্লেষকরাএ-ও বলছেন, অন্য ছাত্র সংগঠনের ‘পদ-পদবি নিয়ে বা আন্ডারগ্রাউন্ডে‘ থেকেও নিজেদের সংগঠনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছে ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতা-কর্মীদের অনেকে। যারা আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ছাত্রশিবিরের ব্যানারে প্রকাশ্যে এসেছেন।
বিশ্লেষকরা জানান, ঢাবিতে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে পরিবেশ পরিষদ গঠিত হয়েছিল। ওই দশকেই পরিবেশ পরিষদের বৈঠকে শিবির ও ছাত্র সমাজ নিষিদ্ধ হয়। পরবর্তীতে সীমিত আকারে ছাত্র রাজনীতি চালিয়ে যায় ছাত্র শিবির। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবি যখন থেকে জোরালো হয়, তখন থেকেই তারা গোপনে রাজনীতি চালাতে শুরু করে। তারা বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে অনেক দমন, নিপীড়ন,গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হয় এবং বহু ছাত্রশিবির নেতা নিহত ও অত্যাচারিত হয়।
তা সত্ত্বেও ‘ক্লিন ইমেজ’-এর কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছাত্র সংসদ ও ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছে। সুসংগঠিতভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে ছাত্রশিবিরের দলীয় কর্মসূচি ও শিক্ষার্থীবান্ধব নানা কর্মকাণ্ড পৌঁছে দেওয়ায় এ অভাবনীয় জয় হয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক ও ডাকসুর এক সাবেক জিএস। তাঁদের মতে, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ (বাগছাস) সংগঠিত ছিল না। এর ফলে শিক্ষার্থীদের কাছে তারা কর্মপরিকল্পনা সঠিকভাবে পৌঁছে দিতে পারেনি। শিবিরের প্রার্থীদের তুলনায় ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন বাম সংগঠন ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি বাদে এবারের ডাকসু ও হল ছাত্র সংসদের নির্বাচন মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হয়েছে। যদিও ছাত্রদল, বাগছাস, ছাত্র ইউনিয়ন ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোটের ফলাফল প্রত্যাখান করেছেন।’
হল ছাত্র সংসদ ও ডাকসু নির্বাচনের ইতিহাসে এই প্রথম ছাত্রশিবির ভিপি, জিএস, এজিএসসহ বেশির ভাগ আসনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে। ছাত্রশিবিরের প্রার্থীরা এর আগে হল সংসদ ও ডাকসু নির্বাচনে এমন কৃতিত্ব অর্জন করতে পারেননি। অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ছাত্রশিবির একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন। এই সংগঠনের ছেলেরা ক্যাডারভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি করে, এটাই তাদের ঐতিহ্য।’
তিনি আরও বলেন– ‘জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্গানাইজডভাবে ডাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠনটি জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম সারির দুই নেতাকে ডাকসুর ভিপি ও জিএস প্রার্থী করেছে। তারা প্রতিটি হল, ফ্যাকাল্টি ও ক্যাম্পাসের আশপাশের ছাত্রাবাসগুলোতে জনসংযোগ করেছে। ছাত্রশিবিরের এবারের ডাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রায় এক বছরের। এই সময়ে তারা বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর কাছে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করেছে।’
ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে সামাজিক আন্দোলনের মতো করে কাজ করেছে। শিবিরের ছেলে-মেয়েরা নানামুখী পড়াশোনা করে, তাদের একাডেমিক ক্যারিয়ারে সাফল্য ঈর্ষণীয়, যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করে। এদের বেশির ভাগেরই আচরণ ভালো। শিবিরের ছেলেদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খবর তেমন একটা পাওয়া যায় না। তাই শিক্ষার্থীদের কাছে ছাত্রশিবিরের প্রতি ‘পজিটিভ ইমেজ’ তৈরি হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা গতানুগতিক ছাত্ররাজনীতির বাইরে ছাত্রশিবিরের ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড কর্মকাণ্ড পছন্দ করেন। তাঁরা হলে ফাউ খাওয়া, বাকিতে খাওয়া, মারামারি, চাঁদাবাজি, গেস্টরুম কালচার ও টর্চার সেল পছন্দ করেন না। শিক্ষার্থীরা চান, তাঁদের জন্য যে বা যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদেরকেই তাঁরা ভোট দেবেন। ডাকসু ও হল সংসদের ভোটের ফলাফলে প্রমাণও মিলেছে। এবার ছাত্রশিবিরের প্রার্থীরা মেয়েদের প্রচুর ভোট পেয়েছেন, যা তাঁদের অভাবনীয় জয়কে ত্বরান্বিত করেছে।
সর্বোপরি বলা চলে, ছাত্রশিবির তাদের ব্যবহার, কার্যক্রম ও তাদের স্বচছ রাজনীতি ও সততার কারনে ধর্ম, বর্ণ ও বিভিন্ন মতাদর্শের শিক্ষার্থী ও জনগনের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এবং শিক্ষার্থীসহ সারা দেশের মানুষ তাদের বিজয়ে উল্লাসিত।
উপসংহার-
ছাত্রশিবির ডাকসু নিয়ে আলোচনা বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির বহুমাত্রিক দিক তুলে ধরে। জনপ্রিয়তার কারণ শিক্ষার্থীদের সমস্যায় সরাসরি ভূমিকা, শক্তিশালী সংগঠন এবং আদর্শভিত্তিক রাজনীতি ও শিক্ষার্থীদের বিপুল সমর্থন।
প্রশ্নত্তোর-
প্রশ্ন: ছাত্রশিবির ডাকসু কেন আলোচনায় আসে?
কারণ তারা ডাকসু নির্বাচনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে শিক্ষার্থীদের সমর্থন অর্জন করেছে এবং বিকল্প রাজনীতির প্রতীক হিসেবে পরিচিত হয়েছে।
প্রশ্ন: ছাত্রশিবির ডাকসু জনপ্রিয় হওয়ার প্রধান কারণ কী?
শিক্ষার্থীদের সমস্যায় সরাসরি ভূমিকা, শক্তিশালী সংগঠন এবং আদর্শভিত্তিক রাজনীতি।
প্রশ্ন: ডাকসুতে ছাত্রশিবিরের প্রভাব কীভাবে পড়েছে?
এটি প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি সৃষ্টি করেছে এবং শিক্ষার্থীদের আরও বিকল্প দিয়েছে।