চাকসু নির্বাচন: ভূমিকা-
২০২৫ সালের এই নির্বাচনে, “চাকসু নির্বাচন- ডাকসুর পর চাকসুতেও শিবিরের জয়যাত্রা” মূল সূর্যে উঠে এসেছে, যা শুধু কেন্দ্রীয় অফিসে সীমাবদ্ধ থেকে যায়নি — পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে শিবিরের প্রভাব প্রদর্শিত হয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতিতে ডাকসুর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) রাজনীতির প্রভাব ও শিবিরের কর্মকাণ্ড প্রায় অভিন্নমতে চলমান। অনেকটা “ডাকসু প্যানেলে জেতার সাফল্য” যেন চাকসু নির্বাচন- ডাকসুর পর চাকসুতেও শিবিরের জয়যাত্রা’র রূপ নিয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব — চাকসুতে ছাত্রশিবিরের জয়জয়কার।
(ছাত্রশিবিরের ডাকসু: কেন আলোচনায় ও জনপ্রিয়তায় এল? এর জনপ্রিয়তার পেছনের ইতিহাস ও প্রভাব)
চাকসু নির্বাচন ইতিহাস-
চাকসু হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ—বিশেষভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠন। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৯ বছরের ইতিহাসে মাত্র সাতবারই চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখনো পর্যন্ত চাকসু নির্বাচন হয়েছে মোট সাতবার — ১৯৭০, ১৯৭২, ১৯৭৪, ১৯৭৯, ১৯৮১, ১৯৯০ এবং সর্বশেষ ২০২৫ সালে। নিয়মিত নির্বাচন বন্ধ থাকায় অনেক সময় ছাত্র নেতা ও স্থানীয় রাজনীতি থেকে শিক্ষার্থীদের বিচ্ছিন্নতার অভিযোগ করা হয়েছে।
ভোট ও ফলাফল বিশ্লেষণ-
২৪ এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে দীর্ঘ ৩৫ বছর পর চাকসু আয়োজনের জন্য ১২ অক্টোবর ভোটের দিন রেখে তফসিল ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। ২০২৫ সালের ১২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের প্রার্থীরা ভিপি-জিএসসহ ছাত্র সংসদের ২৬টি পদের মাঝে ২৪টি পদে নির্বাচিত হয়ে ৪৪ বছর পর অভাবনীয় এক জয়ে চাকুসতে প্রত্যার্বতন করছে। এর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে একচেটিয়া জয়ের ধারা বহাল রাখল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠনটি।
সাড়ে তিন দশক পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) নির্বাচনে বিশাল জয় পেয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির; প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে না পেরে ভরাডুবি হয়েছে ছাত্রদল।
ভিপি হিসেবে শিবির সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের ইব্রাহীম হোসেন রনি ৭,৯৮৩ ভোট পেয়ে এবং জিএস পদে সাঈদ বিন হাবিব ৮,০৩১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন।
তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন হৃদয় ৪,৩৭৪ ভোট এবং জিএস প্রার্থী মো. শাফায়াত হোসেন পেয়েছেন ২,৭২৪ ভোট।শুধু এজিএস ও সহ খেলাধূলা ও ক্রীড়া সম্পাদক পদে জয় পায়নি ছাত্রশিবির। এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন ছাত্রদলের আইয়ুবুর রহমান তৌফিক। তিনি পেয়েছেন ৭,০১৪ ভোট। তার প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের সাজ্জাত হোছন মুন্না পেয়েছেন ৫,০৪৫ ভোট। অপরদিকে সহ-খেলাধূলা ও ক্রীড়া সম্পাদক পদে জয়ী হয়েছেন তামান্না মাহফুজ স্মৃতি; যিনি ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেলের প্রার্থী হয়ে ভোটে লড়েছেন।
জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে আয়োজিত এ নির্বাচনে ছাত্রদল প্রচারের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ার আভাস দিলেও শেষ পর্যন্ত শিবিরের কাছে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয়েছে। কোনো ধরনের গোলযোগ ছাড়া ভোটগ্রহণের পর ভোর পৌনে ৫টার দিকে বাণিজ্য অনুষদের মিলনায়তনে ফল ঘোষণা শুরু করেন চাকসু নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন। চাকসুর মোট ২৬টি পদের মধ্যে ২১টি সম্পাদকীয় পদের ১৯টিতে জয় পান ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা। নির্বাহী সদস্য পদের পাঁচটির সবগুলোতেও জয় পায় তারা।
কেন এমন জয়? — কারণ ও বিশ্লেষণ-
১. ঐক্যবদ্ধ প্রচারণা এবং সমন্বয়
ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল প্রচারণা শুরু থেকেই একযোগে ও সমন্বিতভাবে পরিচালিত করেছে। প্রচারপত্র, মসজিদ প্রাঙ্গণ, কুশল বিনিময়—সব জায়গাতেই তাদের উপস্থিতি চোখে পড়েছে। যদিও ক্যাম্পাস বন্ধ ছিল (দুর্গাপূজা উপলক্ষে), সেই সময়েও অনলাইন ও অফলাইনভাবে প্রচারণা চালিয়ে গেছেন প্রার্থীরা।
২. ডাকসু থেকে আসা “মডেল”
ডাকসুতে শিবিরের শক্তিশালী অবস্থান—যেখানে তারা প্রভাব তৈরি করেছে—এটি একটি মডেল হিসেবে চাকসুতে প্রযোজ্য করতে পেরেছে। ভোটারদের মনোভাব গঠনে, বস্তুনিষ্ঠ ইমেজ গড়তে ও বুনিয়াদি সংগঠনা দেয়ার ক্ষেত্রে ডাকসুর অভিজ্ঞতা কাজে এসেছে।
৩. বিরোধীদের অপ্রতুল সংগঠন
ছাত্রদল বা অন্যান্য প্যানেলগুলো তুলনামূলকভাবে সমন্বিত ও শক্তিশালী প্রচারণা করতে ব্যর্থ হয়েছে, বিশেষ করে তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। কিছু অভিযোগও উঠেছে নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিতা ও অনিয়ম নিয়ে।
৪. শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও বিশ্বাস-
এই নির্বাচনে ছিল প্রত্যাশা ও বিশ্বাস। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রশিবিরের নৈতিকতা, নেতৃত্বে আস্থা রাখে। তাদের আস্থা ছাত্রশিবিরের জয়ের মাধ্যমে অরাজকতা-বিশৃঙ্খলা শেষ হয়ে সব সুশৃঙ্খল হবে। প্রশাসনিক বাধা ও সময়ের সংকট থাকা সত্ত্বেও ভোটাররা অংশ নিতে উৎসাহী ছিল।
উপসংহার-
২০২৫ সালের চাকসু নির্বাচন শুধুই একটি নির্বাচন ছিল না — এটি এক ধরনের রাজনৈতিক সংকেত। “চাকসু নির্বাচন- ডাকসুর পর চাকসুতেও শিবিরের জয়যাত্রা” ইতিমধ্যে একটি বাস্তবতা। যখন শিবির সমর্থিত প্রার্থীরা সাংবাদিকতার কেন্দ্রীয় পদ পর্যন্ত জয়লাভ করতে সক্ষম হয়েছে, তখন তা ছাত্র রাজনীতির দিক পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন-
প্রশ্ন ১: “চাকসু নির্বাচন- ডাকসুর পর চাকসুতেও শিবিরের জয়যাত্রা” মানে ঠিক কী?
উত্তর: এটি বোঝায় যে ডাকসুতে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে) শিবিরের প্রভাব ও সাফল্য যা ছিল, সেটি এখন চাকসু (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) পর্যায়েও প্রতিফলিত হয়েছে—শিবির সমর্থিত প্রার্থীরা চাকসু নির্বাচনে ব্যাপকভাবে জয় লাভ করেছে।
প্রশ্ন ২: শিবিরের জয় কতটা বিস্তৃত?
উত্তর: ২৬টি কেন্দ্রীয় পদে ২৪টিতে শিবির সমর্থিত প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।
২১টি সম্পাদকীয় পদে ১৯টিতে জয়লাভ।
প্রশ্ন ৩: নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ছিল?
উত্তর: ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কিছু ইস্যু (সইবিহীন ব্যালট, অমোচনীয় কালি ব্যাবহার না হওয়া) উল্লেখ করা হলেও, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন দাবি করেছে এটি শান্তিপূর্ণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল।
প্রশ্ন ৪: ভবিষ্যতে এই নির্বাচন শিক্ষার্থীদের জন্য কি পরিবর্তন আনবে?
উত্তর: যদি নির্বাচিত নেতৃত্ব প্রতিশ্রুতিবদ্ধভাবে কাজ করে, তাহলে শিক্ষার্থীদের অধিকারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হতে পারে—নির্বাহী সংলাপ, অবকাঠামো উন্নয়ন, নিরাপত্তা বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে।