
রেলস্টেশনের পাশে খুলনায় মি. চার্লিয়ারের কুঠিবাড়ির পরিচিতি-
খুলনার ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার মাঝে, রেলস্টেশনের পাশে খুলনায় মি. চার্লিয়ারের কুঠিবাড়ি একটি অনন্য এবং প্রায় বিস্মৃত ঐতিহাসিক নিদর্শন। এটি ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত একটি প্রাচীন বাংলো, যা একসময় ব্রিটিশ রেলওয়ে অফিসার মি. চার্লিয়ারের বাসভবন ছিল।
এই কুঠিবাড়িটি স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্বে ভরপুর, যা এখনো সময়ের সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিচে আমরা এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটির ইতিহাস, স্থাপত্য, বর্তমান অবস্থা এবং দর্শনীয় গুরুত্ব বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।
মি. চার্লিয়ারের ইতিহাস ও খুলনায় তাঁর ভূমিকা-
মি. চার্লিয়ার ছিলেন ব্রিটিশ রেলওয়ের একজন উচ্চপদস্থ প্রকৌশলী এবং প্রশাসক। তিনি উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে Eastern Bengal Railway (EBR) এর বিভিন্ন প্রকল্পের সাথে জড়িত ছিলেন।
খুলনা শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে রেলস্টেশনের পাশে এই কুঠিবাড়িটি তৈরি করা হয় তাঁর বাসস্থান হিসেবে, যাতে তিনি কাছাকাছি থেকে রেলওয়ের কাজ তদারকি করতে পারেন। এটি সেই সময়কার সরকারি কলোনির অংশ হিসেবে গড়ে ওঠা এক অসাধারণ স্থাপনা।
কুঠিবাড়ির স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য-
এই কুঠিবাড়িটির ডিজাইনে রয়েছে ঔপনিবেশিক স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন। এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
- ঢালু টিনের ছাদ
- চারপাশে খোলা বারান্দা
- চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত পাকা দেয়াল
- বড় বড় কাঠের জানালা ও দরজা
- বাতাস চলাচলের জন্য উঁচু ছাদ ও খোলা ভেন্টিলেশন
এই রকম স্থাপত্য ডিজাইন মূলত তপ্ত ও আর্দ্র আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য করা হতো। বৃহৎ বারান্দা এবং উচ্চ ছাদ গরমের সময় ভিতরে শীতলতা বজায় রাখত।
লোকেশন: খুলনা রেলস্টেশনের পাশে-
রেলস্টেশনের পাশে খুলনায় মি. চার্লিয়ারের কুঠিবাড়ি এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এর অবস্থান। এটি খুলনা রেলস্টেশনের একদম পাশেই অবস্থিত, যা ঐ সময়কার রেলওয়ে অফিসারদের জন্য অত্যন্ত কৌশলগতভাবে সুবিধাজনক ছিল।
এটি সেই সময়কার পরিকল্পিত নগরায়নের একটি অংশ, যেখানে প্রশাসনিক অফিসারদের জন্য কুঠিবাড়িগুলো নির্মাণ করা হতো কৌশলগত স্থানগুলোতে।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও শহর-ঐতিহ্য-
এই কুঠিবাড়িটি শুধু একটি বাড়িই নয়, এটি ঔপনিবেশিক প্রশাসনের পরিকল্পনা ও পরিবহনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এখানে বসেই রেলওয়ের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সভা, এবং পরিদর্শনের কাজ পরিচালিত হতো।
এখনো পর্যন্ত এই রকম প্রাচীন কুঠিবাড়িগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম, যা এখনো দাঁড়িয়ে আছে এবং আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ব্রিটিশ শাসনামলের অবকাঠামোগত চিন্তাভাবনার।
বর্তমান অবস্থা ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা-
বর্তমানে এই কুঠিবাড়ির অবস্থা অনেকটাই করুণ। কিছু সমস্যার মধ্যে রয়েছে:
- সরকারি স্বীকৃতির অভাব
- পাশের দোকানপাট ও রেলওয়ে কোয়ার্টারের দখল
- নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব
- প্রাকৃতিক ক্ষয় ও অবহেলা
এই কুঠিবাড়িটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পক্ষ থেকে এখনো কোনো সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ঘোষিত হয়নি।
পর্যটন সম্ভাবনা-
সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রচারণা করা হলে, রেলস্টেশনের পাশে খুলনায় মি. চার্লিয়ারের কুঠিবাড়ি হতে পারে:
- একটি ঐতিহাসিক জাদুঘর
- খোলা পর্যটন কেন্দ্র
- ইতিহাস ও স্থাপত্য শিক্ষার স্থান
খুলনা রেলস্টেশনের মতো একটি কেন্দ্রীয় জায়গায় অবস্থিত হওয়ায়, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে এটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে।
কিভাবে যাবেন মি. চার্লিয়ারের কুঠিবাড়ি?-
এই ঐতিহাসিক স্থানে পৌঁছাতে খুব সহজ:
- খুলনা রেলস্টেশনে ট্রেনে নেমে নিন।
- স্টেশনের উত্তর পাশের এক্সিট দিয়ে বের হয়ে কিছুদূর হাঁটলেই আপনি দেখতে পাবেন এক পুরনো বাড়ি, বড় গাছের আড়ালে—এটাই সেই কুঠিবাড়ি।
এখনো এটি সরকারিভাবে পর্যটকদের জন্য খোলা না হলেও বাইরে থেকে দেখে উপভোগ করা যায়।
একটি জীবন্ত ইতিহাস শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে-
এই কুঠিবাড়িটি ইতিহাস শিক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে:
- ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক স্থাপত্য শিক্ষা
- খুলনার রেলওয়ের ইতিহাস জানার উপায়
- ঐতিহাসিক নগর পরিকল্পনা নিয়ে গবেষণা
স্থানীয় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি হতে পারে একটি প্রাকটিকাল লার্নিং স্পট।
উপসংহার-
রেলস্টেশনের পাশে খুলনায় মি. চার্লিয়ারের কুঠিবাড়ি একটি ঐতিহাসিক সম্পদ, যা খুলনার শহুরে ও ঔপনিবেশিক ইতিহাসের নিদর্শন বহন করে। সংরক্ষণ ও পরিচর্যা করলে এটি হতে পারে খুলনার অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
আমাদের উচিৎ এই রকম স্থাপনাগুলোকে শুধু ইতিহাস নয়, ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য জীবন্ত শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা।
প্রশ্নোত্তর –
রেলস্টেশনের পাশে খুলনায় মি. চার্লিয়ারের কুঠিবাড়ি কী?
– এটি একটি ঔপনিবেশিক আমলের কুঠিবাড়ি যা ব্রিটিশ অফিসার মি. চার্লিয়ারের বাসভবন ছিল।
মি. চার্লিয়ার কে ছিলেন?
– তিনি ছিলেন ব্রিটিশ রেলওয়ের একজন প্রকৌশলী, যিনি খুলনার রেলওয়ে সম্প্রসারণে ভূমিকা রেখেছিলেন।
এই কুঠিবাড়িতে প্রবেশ করা যায় কি?
– সরকারিভাবে খোলা না হলেও বাইরে থেকে দেখা যায়, এবং অনেকেই ছবি তুলতে যান।
এই কুঠিবাড়ির ইতিহাসিক গুরুত্ব কী?
-এটি ব্রিটিশ আমলে রেলওয়ে ব্যবস্থাপনার অংশ ছিল এবং খুলনার নগর ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
এই কুঠিবাড়ির স্থাপত্য কেমন?
– ঢালু টিনের ছাদ, বড় বারান্দা, কাঠের দরজা-জানালা এবং চুন-সুরকির দেয়ালসহ এটি একটি ক্লাসিক ঔপনিবেশিক স্থাপত্য নিদর্শন।
বর্তমানে এর অবস্থা কেমন?
– খুবই অবহেলিত এবং অরক্ষিত অবস্থায় আছে। সংরক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।
এটি পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে কি?
– অবশ্যই। সরকার উদ্যোগ নিলে এটি খুলনার ঐতিহ্যবাহী পর্যটনস্থানে পরিণত হতে পারে।
সংরক্ষণে জনগণ কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?
– সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক প্রচারণা এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে চাপে রাখার মাধ্যমে জনগণ সাহায্য করতে পারে।
সরকার কি এটিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে?
– এখনো পর্যন্ত নেই। তবে স্থানীয় ইতিহাসবিদরা এর জন্য আবেদন করেছেন।
রেলস্টেশনের পাশে হওয়াটা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
– এটি ঐ সময়কার নগর পরিকল্পনার দৃষ্টান্ত, যেখানে প্রশাসনিক বাসস্থানগুলো পরিবহনকেন্দ্রিক এলাকাতেই তৈরি করা হতো।