কাতারে ইসরায়েলের হামলা: ভূমিকা-
মধ্যপ্রাচ্য আজ আবারও উত্তাল। সম্প্রতি কাতারে ইসরায়েলের হামলা বিশ্ব রাজনীতিতে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে, এই হামলার সময় হামাস নেতারা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। অনেকে বলছেন, নামাজে যাওয়ার কারণেই তারা বেঁচে গেছেন। এই ঘটনা শুধু একটি সামরিক ইস্যু নয়, বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে ধর্ম, রাজনীতি ও আঞ্চলিক শক্তির সমীকরণ। প্রশ্ন উঠছে—এটি কি নিছক একটি কাকতালীয় ঘটনা, নাকি এর মধ্যে গভীর কোনো বার্তা লুকিয়ে আছে?
কাতারে ইসরায়েলের হামলার পটভূমি-
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে হামাসকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে আসছে। হামাসের অনেক শীর্ষ নেতা কাতারে রাজনৈতিক নির্বাসনে থাকেন। গাজায় চলমান সংঘাতের মাঝেই কাতারে ইসরায়েলের এই হামলা এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। কারণ, এতদিন কাতারকে তুলনামূলক নিরাপদ মনে করা হতো। এই হামলা প্রমাণ করেছে, ইসরায়েল তাদের টার্গেটে কোনো ছাড় দিচ্ছে না, এমনকি তৃতীয় দেশেও হামাস নেতাদের নিশানা করছে।
নামাজে যাওয়ার কারণে হামাস নেতাদের বেঁচে যাওয়া – কাকতালীয় নাকি আল্লাহর রহমত?-
কাতারের রাজধানী দোহায় মঙ্গলবার হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে ইসরায়েলের চালানো হামলা ব্যর্থ হয়েছে। আরব গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলার আগে নেতারা নামাজ আদায় করতে গিয়েছিলেন। তখন বৈঠকস্থলে তাঁরা মুঠোফোনগুলো রেখে যান। আর এসব ফোনের সংকেত ব্যবহার করেই হামলা চালানো হয়।
সৌদি আরবের মালিকানাধীন সংবাদপত্র আশার্ক আল-আওসাত প্রতিবেদন করেছে, নেতারা হামলার সময় মূল ভবনের (বৈঠকের স্থান) বাইরে অন্য একটি বাড়িতে ছিলেন। মূল ভবন হামলার নিশানা হওয়ায় এবং সেই সময় আলাদা স্থানে অবস্থান করায় তাঁরা বেঁচে গেছেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, দোহায় হামলাটি হামাসের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার বৈঠককে লক্ষ্য করে চালানো হয়। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠনটির রাজনৈতিক ব্যুরোর সহসভাপতি খলিল আল-হায়া ছিলেন মূল লক্ষ্য। পশ্চিম তীরের হামাস নেতা জাহের জাবারিন ও রাজনৈতিক দপ্তরের সদস্য নিজার আওয়াদাল্লাহও প্রাথমিকভাবে নিহত হয়েছেন বলে মনে করা হয়েছিল।
আল-হায়ার পাশাপাশি সহসভাপতি খালেদ মেশালও মূল ভবনে উপস্থিত ছিলেন না। তাঁরা দুজনই জীবিত আছেন। হামাস দাবি করেছে, তাদের কোনো নেতা নিহত হননি। তবে ফিলিস্তিনি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, আল-হায়ার ছেলে হিমাম এবং তাঁর কার্যালয়ের পরিচালক জিহাদ লাবাদ নিহত হয়েছেন।
আল-জাজিরা জানিয়েছে, বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফ প্রস্তাবিত সর্বশেষ শান্তিচুক্তি নিয়ে আলোচনা করা। টাইমস অব ইসরায়েলকে একজন অজ্ঞাত কাতারি জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, বৈঠকের জন্য উপস্থিত নেতারা তুরস্ক থেকে দোহায় এসেছিলেন।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘আইডিএফ এবং আইএসএ (শিন বেত) হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতাদের লক্ষ্য করে সুনির্দিষ্ট একটি হামলা চালিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে এ হামাস নেতারা সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। তাঁরা ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলার জন্য সরাসরি দায়ী এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কাতারে হামলার আগে, বেসামরিক মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে, যেমন সঠিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার ও অতিরিক্ত গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা। আইডিএফ এবং আইএসএ দৃঢ়ভাবে হামাসকে পরাজিত করতে কাজ চালিয়ে যাবে।’
ইসরায়েলের চ্যানেল ১২-এর বারাক রাভিদ বলেন, একজন ইসরায়েলি কর্মকর্তা তাঁকে নিশ্চিত করেছেন, এ অভিযান ছিল ‘হামাস কর্মকর্তাদের হত্যার চেষ্টা’; যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘সামিট অব ফায়ার’। ইসরায়েলের বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার লাপিড বিমানবাহিনী, আইডিএফ, শিন বেত ও ইসরায়েলি সব নিরাপত্তা বাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘তারা আমাদের শত্রুকে প্রতিহত করতে অসাধারণ অভিযান চালিয়েছে।’
একই সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ হামলার ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছেন, যদিও কাতারের সঙ্গে তাঁর প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এ বিষয়ে ওয়াশিংটন তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় এ অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের অভিযোগকে ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করেছে। তারা বলছে, হামাস নেতাদের বিরুদ্ধে আজকের অভিযান ইসরায়েলের সম্পূর্ণ স্বাধীন উদ্যোগ।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বলেছে, ‘ইসরায়েল এ হামলার উদ্যোগ নিয়েছে, এটি পরিচালনা করেছে এবং এর পূর্ণ দায় নিচ্ছে।’
এদিকে এ হামলার নিন্দা জানিয়েছে কাতার। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘এ অপরাধমূলক হামলা সব আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়মের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এটি কাতারের জনগণ ও কাতারে থাকা লোকজনের নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি।’মুখপাত্র আরও বলেছেন, ‘এ হামলার আমরা শক্তভাবে নিন্দা জানাই। কাতার কখনোই এ ধরনের বেপরোয়া ইসরায়েলি আচরণ সহ্য করবে না এবং নিজের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোনো হামলা সহ্য করবে না।’
অবশ্য এ হামলার প্রশংসা করেছেন ইসরায়েলি রাজনীতিবিদেরা। অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ এটিকে ‘সঠিক সিদ্ধান্ত’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে স্মোট্রিচ লিখেছেন, ‘‘‘সন্ত্রাসীদের’’ কোনো ছাড় নেই এবং ভবিষ্যতেও হবে না। ইসরায়েলের দীর্ঘ হাত বিশ্বের যেকোনো স্থানে ঘিরে ধরবে তাঁদের।’
ইসরায়েলি কৌশল: শুধু গাজা নয়, বিশ্বজুড়ে টার্গেট-
ইসরায়েলের হামলা প্রমাণ করে যে, তারা শুধু গাজায় নয়, বিশ্বব্যাপী হামাস নেতাদের টার্গেট করছে। কাতার, তুরস্ক এমনকি লেবাননেও হামাসের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের উপস্থিতি রয়েছে। কাতারে ইসরায়েলের হামলা সেই বার্তা দিয়েছে—যেখানেই থাকুক, ইসরায়েল হামাসকে নির্মূল করতে চাইবে। আর এই হামাস নেতাদের নির্মূলের নামে মুসলিম দেশগুলোতে তারা নির্যাতন ও হামলা চালিয়ে তারা মধ্যপ্রাচ্য বা আরব দেশগুলোর দখল নিয়ে শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা চালাবে।
কাতারের রাজনৈতিক অবস্থান-
কাতার দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনি ইস্যুতে সমর্থন দিয়ে আসছে। তারা হামাসের কিছু নেতাকে আশ্রয় দিয়েছে এবং মানবিক সহায়তাও দিয়েছে গাজায়। ফলে কাতারে ইসরায়েলের হামলা শুধু একটি সামরিক ঘটনা নয়, বরং এটি কাতারের কূটনৈতিক অবস্থানের উপর সরাসরি আঘাত। এটি ভবিষ্যতে কাতারের সাথে অন্যান্য আরব রাষ্ট্র এবং পশ্চিমাদের সম্পর্কেও প্রভাব ফেলতে পারে।
হামাস নেতাদের জন্য শিক্ষা-
হামাস নেতারা এবার নামাজের কারণে প্রাণে বেঁচে গেলেও বিষয়টি তাদের জন্য এক বড় শিক্ষা। তারা বুঝতে পারছে, ইসরায়েল যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে তাদের টার্গেট করতে পারে। তাই নিরাপত্তা বাড়ানো, গোপন আস্তানা পরিবর্তন করা এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাড় করা এখন তাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ: নামাজের শক্তি-
কাতারে ইসরায়েলের হামলার ঘটনায় নামাজের গুরুত্ব নতুনভাবে সামনে এসেছে। মুসলিম সমাজে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে—আল্লাহ কিভাবে তাঁর বান্দাদের সুরক্ষা দেন। নামাজ শুধু আত্মিক প্রশান্তিই দেয় না, বরং জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অদৃশ্য সুরক্ষাও আনতে পারে। এই ঘটনা মুসলিম সমাজে নামাজের প্রতি নতুন করে আগ্রহ জাগিয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া-
কাতারে ইসরায়েলের হামলা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কাতার এটিকে তাদের সার্বভৌমত্বের উপর হামলা হিসেবে দেখছে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবে পশ্চিমা বিশ্বে এ নিয়ে খুব বেশি সমালোচনা শোনা যায়নি। বরং ইসরায়েলের নিরাপত্তার যুক্তি সামনে আনা হয়েছে। এতে আবারও প্রমাণিত হলো, ভূ-রাজনীতির স্বার্থ মানবিক মূল্যবোধের ঊর্ধ্বে স্থান পাচ্ছে।
অমানবীয় যুদ্ধনীতি বনাম মানবতার প্রশ্ন-
ইসরায়েলের এই হামলা আবারও প্রমাণ করেছে, আধুনিক যুদ্ধে মানবিক মূল্যবোধকে তুচ্ছ করা হচ্ছে। অন্য দেশের ভেতরে গিয়ে টার্গেট হত্যা করা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটি শুধু কাতারের সার্বভৌমত্বকেই হুমকির মুখে ফেলেনি, বরং আন্তর্জাতিক আইনের ভবিষ্যতকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
প্রশ্নত্তোর-
প্রশ্ন: কাতারে ইসরায়েলের হামলার কারণ কী ছিল?
ইসরায়েল হামাস নেতাদের টার্গেট করেই কাতারে হামলা চালায়। তারা মনে করে হামাস তাদের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি।
প্রশ্ন: হামাস নেতারা কীভাবে এই হামলা থেকে বেঁচে গেলেন?
হামাস নেতারা তখন নামাজে ছিলেন। ফলে টার্গেট হওয়া স্থানে অনুপস্থিত থাকায় তারা প্রাণে বেঁচে যান।
প্রশ্ন: কাতারে ইসরায়েলের হামলা আন্তর্জাতিক আইনে বৈধ কি?
না। অন্য দেশের ভেতরে গিয়ে হামলা চালানো আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটি কাতারের সার্বভৌমত্বকেও ক্ষুণ্ণ করেছে।
প্রশ্ন: মুসলিম উম্মাহ এই ঘটনায় কী পদক্ষেপ নিতে পারে?
মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ন্যায়বিচারের দাবিতে সোচ্চার হতে হবে।
প্রশ্ন: নামাজের কারণে হামাস নেতাদের বেঁচে যাওয়া কিভাবে দেখা হচ্ছে?
মুসলিম সমাজে একে আল্লাহর রহমত হিসেবে দেখা হচ্ছে। অনেকে বিশ্বাস করেন, নামাজ শুধু আত্মিক প্রশান্তিই নয়, বরং বাস্তব জীবনে অদৃশ্য সুরক্ষাও দেয়।