আফগানিস্তানের ভারত সফর: ভূমিকা-
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্রে আফগানিস্তান ও ভারতের সম্পর্ক সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সাম্প্রতিক সময়ে আফগানিস্তানের ভারত সফর নতুন করে আলোচনায় এসেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঙ্গনে। এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত জানবো — কেন এই সফর এত গুরুত্বপূর্ণ, এর মাধ্যমে কী ধরনের নতুন সম্পর্কের সূচনা হতে পারে, এবং আফগানিস্তান ও ভারতের মধ্যে ভবিষ্যতে কী ধরনের কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক পরিবর্তন দেখা যেতে পারে।
আফগানিস্তানের ভারতের সফর-
আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ভারতের দিল্লিতে সফর করেছেন ৯ অক্টোবর ২০২৫ বৃহস্পতিবার।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নিষিদ্ধ সন্ত্রাসীদের তালিকায় রয়েছেন মি. মুত্তাকি। তাই ভারত সফরের জন্য তার বিশেষ ছাড়ের প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জসওয়াল জানিয়েছেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কমিটি আমির খান মুত্তাকিকে এই সফরের অনুমতি দিয়েছে। তার এই আটদিনব্যপী সফরের সূচনা হয়েছে বৃহস্পতিবার।
প্রসঙ্গত, মি. মুত্তাকির সফর এমন এক সময় হচ্ছে যখন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমারও ভারতে। তার সঙ্গে রয়েছে প্রতিনিধিদের একটা বড় দল। আফগানিস্তানে ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর আমির খান মুত্তাকির প্রথম ভারত সফর।গত জুলাই মাসে ভারত ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়, সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই সফরের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। মুম্বাইয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তার ইতোমধ্যে সাক্ষাৎ হয়েছে, যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনও হয়েছে।
তালেবান সরকারকে ভারতের স্বীকৃতি-
এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, ভারত কিন্তু এখনো তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। ঐতিহাসিকভাবে, ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও ২০২১ সালে তালেবানদের ক্ষমতায় ফেরার পর কাবুলে নিজেদের দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দিল্লি। এর এক বছর পর বাণিজ্য, চিকিৎসা সহায়তা এবং মানবিক সহায়তার মতো বিষয়গুলোকে সহজতর করার জন্য সেখানে ছোট মিশন খোলা হয়। তালেবানকে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেবে কিনা সে বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জসওয়ালকে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো উত্তর দেননি। আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর পর চার বছর হয়ে গেছে এবং রাশিয়া বিশ্বের প্রথম দেশ যারা তালেবানকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা ছাড়া কোনো দেশই আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবানকে গ্রহণ করেনি। এমনকি পাকিস্তানও তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। তবে ভারত স্বীকৃতি না দিলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক হয়েছে।
সম্প্রতি রাশিয়ায় আয়োজিত ‘মস্কো ফরম্যাট কনসালটেন্স’-এ আফগানিস্তানের বাগরাম এয়ার বেস যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে মন্তব্য করেছিলেন, তার বিরোধিতা জানানো হয়। যেকটা দেশ মিলে ওই যৌথ বিবৃতি জারি করেছে, সেই তালিকায় ভারতও রয়েছে, যদিও ওই এয়ার বেসের নাম সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। এইসব বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে মি. মুত্তাকির এই ভারত সফরের দিকে সবার নজর রয়েছে। দুই দেশের কী স্বার্থ রয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
সফরের কারণ-
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালেবানের সাথে ভারতের এই সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস বাস্তববাদী নীতির অংশ। নয়াদিল্লি এখন আফগানিস্তানে পাকিস্তানের প্রভাব মোকাবিলা করতে চাইছে। আফগানিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্ক নতুন করে দিল্লির অস্বস্তিও বাড়াচ্ছে। পাকিস্তানে সীমান্ত-সংক্রান্ত হামলাকে কেন্দ্র করে বর্তমানে বেশ টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দিল্লি।
বিশ্লেষকদের মতে, অতীতে তালেবানকে এড়িয়ে চলার ফলস্বরূপ (আঞ্চলিক মিত্র পাকিস্তানকে ছেড়ে দেওয়া) যে মূল্য দিতে হয়েছে, তা এবার ভারতকে কাবুলের সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে বাধ্য করেছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক প্রবীণ দোনথি বলেন, এটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যা আদর্শগত কারণে উপেক্ষা করা যায় না।
তাছাড়া সফরের আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি, ইনভেস্টমেন্ট, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানসহ একাধিক বিষয়। মুত্তাকি তার সফরকালে ভারতীয় কর্মকর্তা, বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে কূটনৈতিক, বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করছেন।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, নব্বইয়ের দশকে তালেবান পাকিস্তানের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এখনকার তালেবান আঞ্চলিক রাজনীতিতে তুলনামূলকভাবে বেশি জোর দিচ্ছে, তারা এখন বৃহত্তর আফগান স্বার্থ দেখতে আগ্রহী।
তাছাড়া, ভারত এটাও বুঝে গেছে আফগানিস্তানে আরও অনেক দিন তালেবানরা ক্ষমতায় থাকতে পারে।
নয়াদিল্লির এই হিসাব-নিকাশে কাবুলের সাথে ইসলামাবাদের ক্রমবর্ধমান সংঘাত গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। সাবেক দূত মুখোপাধ্যায় মনে করেন, ভারত ও তালেবান উভয়েরই পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্যা ও অভিযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, এটাই দুই দেশকে মিত্র করে তুলছে।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান এখন তাদের প্রতিপক্ষ আর হিন্দু জাতীয়তবাদী সরকারের অধীনে চলা ভারত এখন তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের ‘কৌশলগত মিত্র’, নতুন অংশীদার। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে এ দৃশ্য কূটনীতিতে ‘বাস্তববাদিতার’ আরেক যুগান্তকারী উদাহরণ। আর ধর্ম ও তাকে পুঁজি করা আবেগ যে কেবল রাজনীতি আর ক্ষমতার হাতিয়ার তাও স্পষ্ট।
অক্টোবরের শুরুতে কাবুল ও পাকতিকা প্রদেশে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের দায় পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে তালেবান সরকার এক অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নিয়েছে। একসময় ইসলামাবাদের আশ্রিত হিসেবে বিবেচিত এই সরকার এখন তার সাবেক মিত্রকেই অভিযুক্ত করছে সন্ত্রাসী হামলার জন্য। ঘটনাটি ঘটেছে এমন এক সময়, যখন তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ভারতে উচ্চপর্যায়ের সফরে ছিলেন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়েছে, তালেবান সরকার পাকিস্তানের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে একটি স্বতন্ত্র কূটনৈতিক পরিচয় গড়তে চাইছে।
অন্যদিকে পাকিস্তান এখন একই সঙ্গে দুই দিকের চাপের মুখে—একদিকে তালেবানের আশ্রয়ে থাকা পাকিস্তান তালেবান (টিটিপি)–এর হামলা, অন্যদিকে আফগানিস্তানের দিক থেকে কূটনৈতিক সম্পর্কচ্ছেদ। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক অক্ষ এখন ইসলামাবাদ নয়, বরং কাবুল ও নয়াদিল্লির নতুন সমীকরণের দিকে ঘুরছে—যেখানে আদর্শ নয়, বাস্তবতা ও স্বার্থই নতুন সম্পর্কের ভিত্তি।
এটা অবশ্য হওয়ারই ছিল। কেননা এই যে স্বার্থ তার উপকারভোগী কাবুল ও নয়াদিল্লি দুই পক্ষই। ভূরাজনীতির বাস্তবতায় ভারতের কাছে আফগানিস্তান মধ্য এশিয়ার প্রবেশদ্বার, আবার পাকিস্তানের সঙ্গে তার যে ঐতিহাসিক টানাপোড়েন, সেখানে পাকিস্তানকে কৌশলগত চাপে রাখার হাতিয়ারও আফগানিস্তান। আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সাম্প্রতিক নয়াদিল্লি সফরের দিকেই তাকানো যাক। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর এটাই ছিল তাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ভারত সফর—যা আগে অকল্পনীয় ছিল। সফরের তাৎপর্য শুধু কূটনৈতিক নয়, দিকনির্ধারকও—পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতির প্রেক্ষাপটে তালেবান এখন ভারতের দিকে ঝুঁকছে, আর দিল্লি তাদের সঙ্গে বাস্তববাদী যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। এই সফরে মুত্তাকি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং এর পরই দিল্লি ঘোষণা দিয়েছে, চার বছর আগে বন্ধ করে দেওয়া কাবুল দূতাবাস তারা পুনরায় খুলবে। মুত্তাকিও বলেছেন, ভারত তাদের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
তালেবান শাসিত কাবুল যে এখন নিজস্ব কূটনৈতিক পরিচয় গড়তে চাইছে তা সাদা চোখেই বোঝা যাচ্ছে। ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাকে পুঁজি করে তারা আঞ্চলিক সমর্থন ও বৈধতার লক্ষ্যে কাজ করছে। এটি এক নতুন সমীকরণ যেখানে বিজেপিশাসিত ভারত ও তালেবান শাসিত আফগানিস্তান, দুই বিপরীত মতাদর্শের সরকার, নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একই টেবিলে বসেছে। ইসলামাবাদের সঙ্গে ক্রমশ দূরত্ব তৈরি হওয়ায় তালেবান এখন দিল্লিকে দেখছে নতুন দরজার মতো—যেখান থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বিনিয়োগ এবং রাজনৈতিক বৈধতার বাতাস আসতে পারে।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতি জানে, তালেবানের সঙ্গে সীমিত সম্পর্ক রাখলে অন্তত দুটি লাভ রয়েছে—প্রথমত, পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের সুযোগ; দ্বিতীয়ত, ইরান ও মধ্য এশিয়ার করিডোর ধরে বাণিজ্যপথে প্রবেশাধিকার। চাবাহার বন্দর, আফগান ট্রানজিট রুট এবং উত্তর–দক্ষিণ ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্কের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আফগান ভূখণ্ডে স্থিতিশীলতা ও নিয়ন্ত্রণের ওপর। ফলে, কাবুলের সঙ্গে কূটনৈতিক সাক্ষাৎ কেবল রাজনৈতিক সৌজন্য নয়—এটি ভারতের আঞ্চলিক অর্থনীতিতে অবস্থান সুদৃঢ় করার পরিকল্পিত পদক্ষেপ।
অন্যদিকে তালেবানেরও প্রয়োজন নতুন বন্ধু—যে বন্ধু তাদের ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ তকমা থেকে ধীরে ধীরে বের করে আনতে সাহায্য করবে। তাই ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তাদের কাছে একধরনের রাজনৈতিক জীবনরক্ষার কৌশল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্যাংশনস কমিটির তালেবানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির ভারত সফরের জন্য সাময়িক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি এসেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বললেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কমিটি আমির খান মুত্তাকিকে এই সফরের অনুমতি দিয়েছে। এক অর্থে এটি তালেবানের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রথম দরজা—যে দরজায় ওপারে ছাতা হাতে দাঁড়ানো ভারত।
সাধারণ প্রশ্নত্তোর-
এই সফরের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?
-অর্থনৈতিক সহযোগিতা, নিরাপত্তা জোরদার, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি, ইনভেস্টমেন্ট, এই সফরের মূল উদ্দেশ্য।
সফর চলাকালীন কী কী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়?
-অবকাঠামো উন্নয়ন, বাণিজ্য সম্প্রসারণ, নিরাপত্তা সহযোগিতা ও শিক্ষা- চিকিৎসাখাতে পারস্পরিক সহায়তার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।